সত্যানুসন্ধান
আত্মজিজ্ঞাসার পথে এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব, যে সন্ধানী সত্যের পথে বেরিয়ে যায়, সে কখনো সহজপথে পৌঁছায় না। পথ তার সূক্ষ্ম, জটিল এবং বিভ্রান্তিকর। পৃথিবী জুড়ে প্রচলিত শত শত মতবাদ, বিশ্বাস, ধর্ম, দর্শন এবং তত্ত্বগুলো এক একটি দরজা খুলে দেয়, কিন্তু কোন দরজা সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তা জানা সহজ নয়। কেউ বলেন, “বস্তুবাদই একমাত্র সত্য”, কেউ বলেন, “ভাববাদই আসল”। কিন্তু ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক সকল চেতনায় যে ধারণাটি প্রবাহিত, তা হলো: “সত্যকে জানার পথ একমাত্র নিজের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে”। অর্থাৎ, সত্য কখনো বাহিরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেটা অমূলক এবং নিজস্ব।
বস্তুবাদী এবং ভাববাদী উভয়ই হয়তো নিজেদেরকে সঠিক দাবি করেন, কিন্তু তারা জানেন না, তাদের শাসনাধীন দৃষ্টিভঙ্গি কতটা সীমিত। বস্তুবাদী বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবী এবং তার সকল বাস্তবতা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং প্রমাণযোগ্য, কিন্তু তারা এই সত্যের আঙ্গিককে অস্বীকার করে যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোও তো সীমিত। একইভাবে, ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, এক অদৃশ্য শাশ্বত শক্তি অথবা অস্তিত্বই একমাত্র সত্য, কিন্তু তারা এই সত্যের প্রকৃত উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত যে, যে কোনও ধারণা, দর্শন বা ধর্মীয় বিশ্বাস নিজেই একধরনের সীমাবদ্ধতা।
সত্যানুসন্ধানী জানে যে, বিশ্বাসকে প্রশ্ন করা, অনুসন্ধানী মনোভাব গড়ে তোলা, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধি বিশ্লেষণ করা – এই পুরো প্রক্রিয়াই সত্যের দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমাদের সমাজে প্রথাগত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা একটি বিপ্লব, আর এই বিপ্লবের সূচনা ব্যক্তির নিজের কাছে, তার অন্তরাত্মায়। যা বাইরের দুনিয়া জেনে, অনুভব করতে পারে না, তা বুঝতে হলে নিজেকে গভীরভাবে খুঁজে বের করতে হবে, খুঁটে খুঁটে করে।
আমরা যখন “দাসত্বকে ‘না’ বলি”, তখন সেই দাসত্ব শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রথা বা রাষ্ট্রীয় শাসনের দাসত্ব নয়, বরং এটি মনের গোঁড়ামি, নীরবতা এবং অভ্যন্তরীণ জড়তা থেকেও মুক্তি। বাহ্যিক ধর্ম, রাষ্ট্র বা ক্ষমতার কাঠামো আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়, কিন্তু সত্যের পথ কখনো বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ।
সত্যানুসন্ধান হলো এক আত্মজ্ঞানীর পথে চলা। যে কখনো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবনা ও মতবাদকে শুদ্ধতার নামে গ্রহণ না করে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। সত্যের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা কোনো বইয়ের পাতা বা কারোর কথায় পাওয়া যায় না, তা জন্ম নেয় মানুষের নিজের অভ্যন্তরীণ আলো থেকে।
তাই, সত্যানুসন্ধান মানে এক গভীর আত্মবিশ্বাস, যেখানে মানুষ বাইরের পৃথিবীর কথা শুনে নিজের মধ্যে বিচলিত না হয়ে, বরং নিজের ভিতরের প্রশ্নগুলোকে অনুসন্ধান করে, তাকে মেনে নিয়ে, নতুন জ্ঞানে অভিযাত্রা করে। পৃথিবীতে যত মতবাদ এবং বিশ্বাস, তা নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকেই আসে। কিন্তু যারা এগুলো প্রশ্ন করে, তারা জানে, সত্য কখনো একটি নির্দিষ্ট জায়গা বা অবস্থানে আটকে থাকে না।
বিশ্বস্ততা নয়, মুক্তি কেবলমাত্র সত্যের সন্ধানে। আমরা যারা সত্যানুসন্ধানী, তারা জানি, সত্য এক অমীমাংসিত অতীত নয়, তা একটি চলমান, জীবন্ত অভিজ্ঞতা যা আমরা প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে নতুন করে অনুভব করতে পারি।
এইভাবে, “সত্যানুসন্ধানী” কখনো না থামার মানসিকতা রাখে—সে জানে যে, পৃথিবী, ধর্ম, দর্শন, রাষ্ট্রের ভ্রমে পূর্ণ কোনো সত্য নেই, তবে, তাকে নিজেই খুঁজে বের করতে হবে, নতুনভাবে।
—ফরহাদ ইবনে রেহান