তন্ত্র এবং শিব দর্শন
দুটোই প্রাচীন ভারতীয় আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত। এদের মধ্যে অনেক মিল এবং পার্থক্য রয়েছে, তবে উভয়ই মনের গভীরে প্রবাহিত শক্তির প্রতি এক গভীর সম্মান এবং তার অস্তিত্বের রহস্য উদ্ঘাটনের দিকে মনোযোগী। এ দুটি ধারার মধ্যে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ দিয়ে শক্তি (শক্তি তন্ত্র) এবং ঈশ্বর বা পরমাত্মা (শিব দর্শন) সম্পর্কিত গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে।
তন্ত্র (Tantra)
তন্ত্র একটি আধ্যাত্মিক এবং আচারিক ব্যবস্থা যা বিশেষত ভারতীয় এবং তিব্বতি ধর্মে প্রভাবশালী। এটি বিশেষভাবে কিছু নির্দিষ্ট আচার, মন্ত্র, যোগ এবং শারীরিক পদ্ধতির মাধ্যমে পরম সত্য, আত্মার মুক্তি এবং ঈশ্বরের সাথে একাত্মতার অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে চলে।
তন্ত্রের মূল বিষয়বস্তু:-
শক্তির পূজা (Shakti Worship)
তন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো শক্তি বা শক্তির দেবী—এই শক্তি প্রকৃতির অপরিহার্য শক্তি এবং পরম সত্যের প্রকাশ। শক্তির আধ্যাত্মিক আর্থ হলো মহাশক্তি, যা কেবল নারীত্বের মধ্যে নয়, পুরুষতাত্ত্বিক শক্তির মধ্যেও বিদ্যমান। শক্তি এবং শিব একে অপরের পরিপূরক।
মন্ত্র এবং তন্ত্রিক আচার
তন্ত্রে মন্ত্র এবং তন্ত্রিক আচার ব্যবহৃত হয় যাতে চেতনা পরিবর্তিত হয় এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি পাওয়া যায়। বিভিন্ন মন্ত্র উচ্চারণ বা পূজা বা যজ্ঞ (যন্ত্র) মানুষের আত্মার শুদ্ধি সাধনা এবং প্রগতি করানোর উদ্দেশ্যে করা হয়।
আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য
তন্ত্রের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য হল পরম সত্যে পৌঁছানো এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক পরিবর্তন আনা। তন্ত্রের মাধ্যমে, সাধক তার নিজস্ব আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং একতা বা পরম সত্যের অনুভূতি লাভ করতে পারে।
মায়া বা বিভ্রমের পরিত্রাণ
তন্ত্রের শিক্ষা অনুযায়ী, মানুষ এই পৃথিবীতে বিভ্রমের মধ্যে রয়েছে এবং এই বিভ্রম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, তাকে শক্তির সঠিক প্রয়োগ ও ধ্যানের মাধ্যমে বিভ্রান্তি থেকে বের হতে হয়।
তন্ত্রের ধরণ
- কপালিক তন্ত্র – এটি একটি জটিল এবং প্রাচীন তন্ত্রিক ধারার অংশ, যা কপালের শ্মশান সম্পর্কিত আচার এবং প্রাণীকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে।
- কামাক্ষা তন্ত্র – এটি শক্তির পূজা এবং তান্ত্রিক পূজার বিভিন্ন রীতি ও আচার প্রচলিত ছিল।
শিব দর্শন (Shaiva Philosophy)
শিব দর্শন বা শৈব দর্শন একটি আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক পরমার্থের প্রতিফলন, যা শিব বা শিবের একত্ব (শিবত্ব) প্রবর্তিত করে। শিব দর্শনে, শিবের অস্তিত্ব শুধু প্রাচীন দেবতা হিসেবে নয়, বরং শিব হলো পরম আত্মা, সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তির একমাত্র উৎস, এবং সৃষ্টির পরিপূর্ণ রূপে উপস্থিত থাকেন। শিবের সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি ঐক্য বা ওয়াহদাতুল উজুদ (একত্বের দর্শন) এর প্রতিফলন।
শিব এবং শক্তি (Shiva and Shakti)
শিব দর্শন অনুযায়ী, শিব এবং শাক্তি একে অপরের পরিপূরক। শিবের দর্শন শুদ্ধ, নিরাকার, এবং নিঃশেষ আত্মার প্রতীক। শাক্তি, তার শক্তি বা ক্রিয়াশক্তি, শিবের ভিন্ন রূপ বা কার্যকারিতা। শিব শক্তি ছাড়া কার্যকরী নয়, এবং শক্তি শিবের অঙ্গ।
আত্মসাক্ষাৎ এবং ব্রহ্মজ্ঞান
শিব দর্শনে আত্মসাক্ষাৎ বা আত্মজ্ঞান অর্জন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ যখন তার অন্তরের শিবের প্রকৃত রূপে প্রবেশ করে, তখন সে নিজের মধ্যে শিবত্বের (ঈশ্বরের অস্তিত্বের) অনুভব করে এবং নিজেকে পরম সত্যের সাথে একাত্ম করে।
যোগ এবং ধ্যান
শিব দর্শনে যোগ এবং ধ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিবের প্রকৃত রূপ উপলব্ধি করার জন্য, মানুষকে গভীরভাবে ধ্যান করতে হয় এবং নিজের মধ্যে শিবের উপস্থিতি অনুভব করতে হয়। এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যেখানে শিবের সাথে একাত্ম হওয়া যায়।
শিবের ত্রি-রূপ (Trinity)
শিবের তিনটি রূপ আছে— ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), বিষ্ণু (পালক), এবং শিব (সংহারক)। এই ত্রি-রূপের মাধ্যমে, শিবের সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বে এক কার্যক্রমের মধ্যে প্রকাশিত হয়।
শিব দর্শনের ধরণ
- শৈব দর্শন বা পুরাণি শৈব দর্শন – যা শিবের পূজা এবং ভক্তির উপর নির্ভরশীল।
- কাশ্মীর শৈব দর্শন – যা শিবের একত্ব ও শিব-শক্তির মধ্যে সম্পর্কের গভীর দর্শন প্রদান করে।
তন্ত্র ও শিব দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক
তন্ত্র এবং শিব দর্শন গভীরভাবে পরস্পর সম্পর্কিত। শিব দর্শনে শিবের সাথে শক্তির একত্বের ধারণা রয়েছে, এবং তন্ত্রে শক্তির পূজা এবং শক্তির মাধ্যমে পরম সত্যে পৌঁছানোর ধারণা রয়েছে। শিবকে তন্ত্রে পুরুষ তন্ত্র বা শিবের শক্তির সঞ্চালক হিসেবে দেখা হয় এবং শক্তি বা শাক্তি হল নারী তন্ত্র বা সেই শক্তি যা শিবের কার্যকারিতা প্রদান করে।
তন্ত্র এবং শিব দর্শন একে অপরকে পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। তন্ত্রে যেখানে মানুষের শক্তির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্মেষের দিকে কাজ করা হয়, শিব দর্শনে সেখানে শিবের সহায়তায় পরম একত্ব এবং আত্মসাক্ষাত অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
সর্বোপরি, শিব দর্শন এবং তন্ত্র উভয়ের লক্ষ্য একটাই— আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা, তবে এগুলির পথে পদ্ধতি এবং অনুসরণীয় রীতির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
– ফরহাদ ইবনে রেহান