চার মঞ্জিলে প্রভুর সাধনা হয়ে থাকে।
চার মঞ্জিলে প্রভুর সাধনা হয়ে থাকে। এখানে মঞ্জিল দ্বারা আমি অবস্থা নয়, বরং বস্তু ও মাধ্যমকে বুঝাচ্ছি। নিন্মে তা উপস্থাপন করছি।
১/
যিকিরে লেছানী বা মৌখিক ইবাদত বা সাধনা:
অর্থাৎ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে যে সাধনা বা ইবাদত করা হয় তাকেই জিকিরে লেছানী বলা হয়। এটা সাধনার সর্বনিম্ন পদ্ধতি ও অবস্থান। প্রত্যেক দরবারেই প্রথম অবস্থায় ভক্তদের বিভিন্ন অজিফা দেওয়া হয়, আর হিন্দুরা দেয় গুরুমন্ত্র বা আরো কিছু। হরিনাম কীর্তন ও আমাদের হালক্বায়ে জিকির এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত। অনেক দরবারে শুধু ভক্তরা এই অজিফার বাইরে আর কিছুই পায় না। তারাই মূলত দূর্ভাগা। আসলে এই যিকির ভক্তের মন পরিষ্কার ও গুরুর প্রতি ভক্তের আনুগত্যের পরীক্ষা স্বরুপ প্রদান করা হয়। তাই অনেক দরবারে অনেক নিয়ম থাকে এই যিকিরের। যেমন নাভী মূল থেকে ‘লা’ বলে টেনে নিয়ে ‘কলব’ পর্যন্ত টেনে নিয়ে ‘ইলাহা’ বলা। আবার এর ভিন্নও আছে। এটাও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেই দিয়ে থাকে। তাই ভক্তরা দম সাধনার কিছুটা উপকার এখান থেকেই পেয়ে যায় ও অনেক উন্নতি লাভ করে থাকে। এটা তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলে প্রভুকে স্বরন করার কোনো পদ্ধতি নেই। তাই এটা নিয়ে আমি আলোচনা করব না।
একটা গানে শুনেছিলাম,
“বহিরঙ্গ ভক্ত নিয়ে করে প্রভু নামকীর্তন,
অন্তরঙ্গ ভক্তে নিয়ে প্রভু করে রসাস্বাদন।”
২/
যিকিরে ক্বালবি বা অন্তরের দ্বারা সাধনা:
মূলত সব সাধনাই এটার অন্তরভুক্ত। কারন সব কিছুই হৃদয় দিয়ে করতে হয়। সর্বদা দয়ালের কথা ভাবা ও সর্ব সাধনা হৃদয় ও মন দিয়ে করতে হয়। ভালবাসা বা প্রেমের বিষয়টা এই স্তরের উপরই নির্ভর করে। তাই এটার গুরুত্ব সর্বাধিক।
৩/
যিকিরে আইনী বা চোখের সাধনা:
এটা এক হিসেবে সাধনার সর্বোচ্চ স্তর। আবার অন্য দৃষ্টিতে তৃতীয় স্তর। কারন যখন অন্য সব সাধনা করতে করতে প্রভুর অপরুপ রূপ দর্শন করবেন নিজের চক্ষে, তখন আর কিছু দেখার বাকী থাকবে না এই চৌদ্দ ব্রহ্মান্ডের। কিন্তু চোখ দ্বারা প্রভুর নিয়ামত গুলোকে দেখে তাঁর কথা ভাবাও এই যিকিরের অন্তরভুক্ত। আবার আপন গুরুকে দর্শন করাও এই জিকিরের অন্তরঙ্গ। আপনি চর্ম চোক্ষে না দেখলে সেটা মনে মনে ভাবতে পারবেন না। তাই দেখা দেখির গুরুত্ব অনেক।
৪/
যিকিরে আনফাছি বা দমের সাধনা:
এটাই মূলত সবচেয়ে বড় সাধনা। মনকে বশে আনতে হয় এই দম সাধনার মাধ্যমেই। অজীফার দ্বারা প্রভুকে পাওয়া যায় না। এখানেই সাঁইয়ের আসা যাওয়া। তাকে এখানেই ধরতে হয়। দম সাধনার মাধ্যমেই মনকে বসে এনে মোরাকাবা মোশাহেদার মাধ্যমে অল্প সময়ে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায়। দম সাধনাই হল সাধারণ ভাবে যোগ সাধন বা প্রাণায়াম। তবে প্রানায়াম মূলত দেহ রক্ষা করার একটা সাধনা। এই সাধনার মাধ্যমেই মনকে স্থির করে মূল সাধনা করতে হয়। তাই কেউ গুরু না ধরেও প্রাণায়াম বা যোগ সাধন (কুম্ভুক, রেচক, পূরক, ইত্যাদি) করে দেহ রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তারা কখনো দমের ঘরের ফকীরি করতে পারবে না। আর প্রভুর দর্শনও পাবে না। আবার অনেকে এই যিকিরের পদ্ধতি হিসেবে বলেন “আল্লাহ’ বলে শ্বাস ভিতরে নিতে ও ‘হু’ বলে শ্বাস বের করতে (মনে মনে বলতে হয়)। অথবা এর বিপরীত। আরো পদ্ধতি আছে। মুলত যিকির মানে স্বরন করা। আর ইহার কোনো পদ্ধতি হয় না।
এই চারটা স্থর ও মাধ্যম একটি অন্যটির সাথে জড়িত। মূলত আসল সাধনা হলো ‘লা’ বা হাহুত +সহস্রার সহস্রদল) মোকামে আমার দয়াল যে ‘হু হু হু’ শব্দ করতেছেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভাবের বাঁশি বাজাচ্ছেন, তাহা শ্রবন করা মোরাকাবা মোশাহেদার মাধ্যমে। এটাকে ‘আনহাদ নাদ’ বলা হয় ও হিন্দু ধর্মালম্বীরা “ঔঁ” কার নাদ বলে। এই ধ্বনি শোনার জন্য মনকে স্থির করতে হয়। আর মনকে স্থির করার জন্যই মূলত দম সাধনা করতে হয়। দুনিয়ার সমস্ত শব্দ বন্ধ করার পর আপন দেহের মাঝে লা মোকামে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তাকেই ‘আনহাদ নাদ’ বলে। এখানেই প্রভুর বাস।
এই শব্দ আসে সহস্রহার সহস্রদল থেকে। এটাই সর্ব শ্রেষ্ঠ সাধনা। সকল ধর্ম ও শাস্ত্রের গুরুগনই মূলত এই সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। আপনি শত চেষ্টা করেও হয়তো এই ধ্বনি শুনতে পাবেন না, আর শুনলেও বুঝতে পারবেন না। কিন্তু গুরু কৃপা করে মূহূর্তেই এই কৃষ্ণের ভাবের বাঁশির সুর আপনাকে শুনিয়ে দিতে পারবেন। এই ‘আনহাদনাদ’ সম্পর্কে সবাই গুরুর কাছ থেকে যেভাবেই হোক তাকে সন্তুষ্ট করে বিস্তারিত জেনে নিবেন।
লেখাঃ DM Rahat
জামালচর ছায়েদিয়া পাক দরবার শরীফ