“ষড়-রসিক বিনে কেবা তারে চেনে” কালামের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।

“ষড়-রসিক বিনে কেবা তারে চেনে” কালামের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।

ষড়-রসিক বিনে কেবা তারে চেনে
যার নাম অধরা।
শাক্ত শৈব বুঝে যেরূপে যে মজে
বৈষ্ণবের বিষ্ণুরূপ নিহারা।।
বলে সপ্ত পান্তির মত সপ্তরূপ ব্যাখ্যিত
রসিকের মন নয় তাতে রত
রসিকের মন রসেতে মগন
রূপ রস জানিয়ে খেলছে তারা।।
হলে পঞ্চতত্ত্ব জ্ঞানী পঞ্চরূপ বাখানি
রসিক বলে সেওতো নিলেন নিত্যগুনী
বেদ বিধিতে যার লীলের নাই প্রচার
নিগুম শহরে সাঁইজি মেরা।।
যেজন ব্রহ্মাজ্ঞানী হয় সে জানতে পায়
না দেখে নাম ব্রহ্ম সার করে হৃদয়
রসিক স্বরূপ রূপ দর্পণে রূপ দেখে নয়নে
লালন বলে রসিক দীপ্তকারা।।

লালন সাঁইজ্বীর কীর্তি ও চিন্তা সত্যিই অসাধারণ। “ষড়-রসিক বিনে কেবা তারে চেনে” গানটি কেবল একটি সঙ্গীতকর্ম নয়, বরং মানুষের দেহ, চেতনা ও আত্মার সূক্ষ্ম সংযোগের এক জীবন্ত দার্শনিক ব্যাখ্যা। এই গানটি রসিকের অন্তরে যে জ্ঞান ও প্রেমের দীপ্তি জাগায়, তা সহজ ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

লালন সাঁইজ্বীর শব্দাবলীতে সব ধর্ম, রীতি, দেহরস ও চেতনার মিলন দৃশ্যমান। গানটি আমাদের শেখায় যে, “অধরা” বা পরম সত্য কেবল রসিক অর্থাৎ দেহ, মন ও আত্মার একাত্ম চেতনার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। তিনি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন যেখানে সূফী, বৈষ্ণব, যোগী, বৌদ্ধ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ একত্রিত হয়। সাইজ্বীর সেই ষড় রসিক বিনে গানটির কিছুটা ব‍্যাখ‍্যা করবো নিচে যতটুকু সাঈজ্বীর কৃপা হয়।

“ষড়-রসিক বিনে কেবা তারে চেনে / যার নাম অধরা”

অর্থ: ষড়-রসিক মানে ছয় রসের রসিক যথাঃশান্ত রস, সখ‍্য রস, দাস‍্য রস, বাৎসল‍্য রস, শ্রীঙ্গার রস, মধুর রস। যিনি এই ছয় রসের রসিক, তারই অন্তরে অধরা পরম সত্তার অনুভূতি জন্মায়।

সূফী তত্ত্ব: “যে নিজেকে জানে, সে তার প্রভুকে জানে।”

কুরআন: “তিনি দৃষ্টির বাইরে, কিন্তু অন্তরে অনুভূত।” (সূরা আশ-শুরা ৪২:১১)

গীতা: “ভক্তির মাধ্যমে আমায় জানা যায়।” (অষ্টাদশ অধ্যায়, ৫৫ শ্লোক)

বৌদ্ধ দর্শন: “অধরা সেই নির্বাণচেতনা, যা রূপ ও নামের ঊর্ধ্বে।”

বাইবেল: “ঈশ্বর আত্মা, আর যারা তাঁকে উপাসনা করে, তাদের আত্মা ও সত্যে উপাসনা করতে হবে।” (যোহন ৪:২৪)

রজঃবীর্য সংযম:

  • রজঃ (নারীর মাসিক) নারী দেহের মূলে জীবনের শক্তি, সৃষ্টিশক্তি।
  • বীর্য: (পুরুষের শুক্র) পুরুষ দেহের মূলে চেতনার বীজ, সৃষ্টিশক্তির মূল।

দুগ্ধ মাতৃত্ব, প্রেম ও করুণা।
মল দেহের বর্জন, ভারসাম্য, অশুচিতা।
মূত্র দেহের ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ।

ঘ্রাণ / ঘাম / অন্যান্য দেহরস বিভিন্ন চক্র পরিশ্রম, শক্তি ও রূপান্তর।

“যিনি রজঃ ও বীর্য সংযমে রাখেন, তাঁর চেতনা সহস্রার চক্রে উঠে ঈশ্বরানুভূতি দেয়। রসিক সেইজন, যিনি দেহরসকে চেতনায় রূপান্তর করেছেন।”

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে: “এ অবস্থায় মস্তিষ্কের মধ্যস্থ গ্রন্থি সক্রিয় হয়, মানুষ একাত্ম চেতনা অনুভব করে।”

অবস্থান: সহস্রার চক্র।

কাজ: ঈশ্বরানুভূতি, পরম ঐক্য।

“শাক্ত শৈব বুঝে যেরূপে যে মজে / বৈষ্ণবের বিষ্ণুরূপ নিহারা”

অর্থ: রসিক সকল ধর্ম ও শক্তির রূপ বুঝতে পারে শক্তি (শাক্ত), চেতনা (শৈব), প্রেম/রস (বৈষ্ণব)।
সব ধর্ম ও পথে একই সত্য বিরাজমান রসিক সেই ঐক্যই দেখে।

সূফী তত্ত্ব: “সকল রূপে তিনিই প্রকাশমান।”

কুরআন: “প্রত্যেকেরই এক দিক আছে, যার দিকে সে মুখ করে।” (সূরা বাকারা ২:১৪৮)

গীতা: “যে যেভাবে আমার কাছে আসে, আমি সেইভাবে তাকে গ্রহণ করি।” (চতুর্থ অধ্যায়, ১১ শ্লোক)

বৌদ্ধ তত্ত্ব: “প্রত্যেক জীবের মধ্যে বুদ্ধত্ব বিরাজ করে।”

বাইবেল: “এক ঈশ্বর, এক আত্মা, যিনি সকলের মধ্যে, সকলের উপরে ও সকলের অন্তরে।” (ইফিষীয় ৪:৬)

রজঃবীর্য সংযম:
নারী: রজঃ, দুধ
পুরুষ: বীর্য

চেতনা ও হৃদয় মিলিত হলে প্রেম ও ঐক্য বিকশিত হয়।

“শক্তি ও চেতনার মিলনেই কুণ্ডলিনী শক্তি সহস্রারে উঠে ঈশ্বররূপে বিকশিত হয়।”

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে: “যখন হৃদয় ও মস্তিষ্কের অনুভূতি এক হয়, তখন মানুষ সমগ্র বিশ্বকে একতার রূপে উপলব্ধি করে।”

অবস্থান: অনাহত চক্র (হৃদয়)।

কাজ: প্রেম, ঐক্যবোধ।

“বলে সপ্ত পান্তির মত সপ্তরূপ ব্যাখ্যিত / রসিকের মন নয় তাতে রত / রসিকের মন রসেতে মগন / রূপ রস জানিয়ে খেলছে তারা”

অর্থ: ধর্মের নানা মত নয়, রসিকের মন মগ্ন ঈশ্বরপ্রেমের রসে।

সূফী তত্ত্ব: “রসিকের অন্তর ধর্মের সকল পথে থেকেও প্রেমে বিলীন থাকে।”

কুরআন: “আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা’দ ১৩:২৮)

গীতা: “যোগী আনন্দে মগ্ন থাকে, আত্মায় আত্মা তুষ্ট হয়।” (ষষ্ঠ অধ্যায়, ২১ শ্লোক)

বৌদ্ধ তত্ত্ব: “ধ্যানে মন প্রশান্ত হলে সুখ আত্মায় বিকশিত হয়।”

বাইবেল: “ঈশ্বর প্রেম, আর যে প্রেমে স্থির থাকে, সে ঈশ্বরে স্থির থাকে, ঈশ্বরও তার মধ্যে।” (১ যোহন ৪:১৬)

রজঃবীর্য সংযম: মানবদেহের সাত ধাতু: রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা, শুক্র।

“সংযমে বীর্যরস মাথায় উঠে অমৃতরসে পরিণত হয়, এই রসই পরমানন্দের উৎস।”

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে: সংযমে শরীরে আনন্দ সৃষ্টিকারী রস নিঃসরণ হয়, যা মন ও দেহকে প্রশান্ত করে।”

অবস্থান: মণিপুর চক্র।

কাজ: শক্তি, আনন্দ, রস।

“হলে পঞ্চতত্ত্ব জ্ঞানী পঞ্চরূপ বাখানি / রসিক বলে সেওতো নিলেন নিত্যগুনী / বেদ বিধিতে যার লীলের নাই প্রচার / নিগুম শহরে সাঁইজি মেরা”

অর্থ: পঞ্চতত্ত্ব (মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ) অতিক্রম করে রসিক অন্তরে ঈশ্বর অনুভব করেন।

সূফী তত্ত্ব: “তিনি প্রথম, শেষ, প্রকাশিত ও গুপ্ত।” (সূরা হাদিদ ৫৭:৩)

গীতা: পাঁচ ভৌতিক উপাদান ও মন মিলেই প্রকৃতি গঠিত।” (সপ্তম অধ্যায়, ৪ শ্লোক)

বৌদ্ধ ধর্ম: পাঁচ উপাদান ও আসক্তি ত্যাগেই নির্বাণ লাভ হয়।”

বাইবেল: মাটি হতে তুমি গঠিত, মাটিতেই তুমি ফিরবে।” (উৎপত্তি ৩:১৯)

“মানুষের দেহ মৃত্তিকা, আর আত্মা ঈশ্বরের নিঃশ্বাস।” (যোব ৩৩:৪)

রজঃবীর্য সংযম: রজঃবীর্য,মল,মূত্র,শ্রীঙ্গার রস।

“দেহের পাঁচ উপাদানেই রস বিরাজ করে; সংযমে সেই রস চেতনায় মিলিয়ে যায়।”

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে: “মানবদেহের পাঁচ উপাদান পরস্পর ভারসাম্য রক্ষা করলে দেহ ও মন পরিশুদ্ধ থাকে।”

অবস্থান: বিশুদ্ধ চক্র।

কাজ: বিশুদ্ধতা, বোধ, সাধনা।

“যেজন ব্রহ্মজ্ঞানী হয় সে জানতে পায় / না দেখে নাম ব্রহ্ম সার করে হৃদয় / রসিক স্বরূপ রূপ দর্পণে রূপ দেখে নয়নে / লালন বলে রসিক দীপ্তকারা”

অর্থ: যিনি ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি অন্তরে ঈশ্বরকে দেখেন, বাহিরে নয়। রসিকের রস আলোর রূপ ধারণ করে।

সূফী তত্ত্ব: “হৃদয় যা দেখে, তা মিথ্যা বলে না।” (সূরা নাজম ৫৩:১১)

গীতা: “যে সর্বত্র আমায় দেখে, আমিও তার মাঝে বাস করি।” (ষষ্ঠ অধ্যায়, ৩০ শ্লোক)

বৌদ্ধ তত্ত্ব: “বোধিলাভে অন্তর্দৃষ্টি ও আলোকানুভূতি জাগ্রত হয়।”

বাইবেল: হৃদয়ে পবিত্রদের ভাগ্যবান, কারণ তাঁরা ঈশ্বরকে দেখিবে।” (মাতিউ ৫:৮)

“ঈশ্বরের রাজ্য তোমাদের অন্তরে।” (লূক ১৭:২১)

রজঃবীর্য সংযম:

যিনি সব রসকে চেতনায় রূপান্তর করেন, তিনি ঈশ্বরকে অন্তরে অনুভব করেন।

  • সংযমে রজঃ ও বীর্য সহস্রার আলো।
  • দুধ প্রেম ও রস।
  • মল-মূত্র দেহের ভারসাম্য ও পরিশুদ্ধি।
  • ঘ্রাণ/ঘাম শক্তি ও রূপান্তর।।

“সংযমে রস মাথায় উঠলে তা আলোতে রূপ নেয়, আত্মা সেই আলোকরসে ঈশ্বরকে অনুভব করে।”

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে: “গভীর ধ্যানে মানবমস্তিষ্কে আলোক অনুভব সৃষ্টি হয়, যা ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা দেয়।”

অবস্থান: আজ্ঞা ও সহস্রার চক্র।

কাজ: জ্ঞান, চেতনা, আলোকরস।

ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন, মানুষের দেহ, মন ও আত্মার মিলনই ঈশ্বরানুভূতির কেন্দ্র। রজঃবীর্য সংযম, প্রেম, সততা ও ভক্তিই “অধরার” পথ। এই রসতত্ত্ব সূফীর “নূর”, বৈষ্ণবের “রস”, যোগীর “কুণ্ডলিনী”, আর বিজ্ঞানীর “চেতনার শক্তি” সব একই সত্যের রূপ।

“রসিক দীপ্তকারা সেই, যার রস আলো হয়ে ওঠে; সেই পায় অধরার সান্নিধ্য।”

“রসিক সেইজন, যিনি দেহের রসকে আত্মার আলোতে রূপান্তর করেন।”

“ষড়-রসিক মানে ছয় চক্রে সিদ্ধ আত্মা, যিনি অধরাকে চেনেন।”

 লেখক ও সংকলক: ফকির জুয়েল সাধু

আরো পড়ুনঃ