চিন্তা সৃষ্টির আদি স্পন্দন

চিন্তা সৃষ্টির আদি স্পন্দন

চিন্তা সৃষ্টির আদি স্পন্দন, যা অস্তিত্বের মূলে লুকিয়ে আছে। চিন্তা থেকে উৎসারিত হয় শব্দ, শব্দ থেকে জন্ম নেয় কর্ম। জগতের প্রতিটি প্রকাশ—সৃষ্টি, স্থিতি, লয়—সবই চিন্তার গভীর ফল। চিন্তা হলো অসীম শক্তির তরঙ্গ, বিশ্বের মৌলিক সত্তা। শব্দ তা ধ্বনিত করে, কর্ম তাকে মূর্ত করে। যেমন উপনিষদে বলা হয়েছে, “প্রজাপতির চিন্তায় সৃষ্টি,” তেমনি চিন্তাই জগতের সৃজনকারী।

চিন্তা যখন গঠনমূলক রূপ নেয়, তখন তা শব্দে রূপান্তরিত হয়। শব্দ, লিখিত বা ধ্বনিত, অন্যের মনে প্রবেশ করে, চেতনায় স্পন্দন জাগায়। গঠনমূলক শব্দ থেকে উদ্ভূত হয় গঠনমূলক কর্ম। কর্ম আবার নতুন চিন্তার জন্ম দেয়, এইভাবে চক্র চলে—চিন্তা, শব্দ, কর্ম। এই চক্র সংসারের চক্রের মতো, যা বৌদ্ধ দর্শনে ভবচক্র নামে পরিচিত, যেখানে চিন্তাই মূল কারণ।

আমরা যা বলি, তা চিন্তার প্রতিধ্বনি—বর্তমান বা অতীতের। যা চিন্তা করিনি, তা বলা অসম্ভব; যা বলিনি, তা করা অসম্ভব। চিন্তা, শব্দ, কর্মের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সৃষ্টি করি। যেমন প্লেটোর আদর্শ জগতে ধারণা সত্য, তেমনি আমাদের চিন্তাই আমাদের সত্তার রূপকার। আমরা যা ভাবি, তাই আমরা—এই দর্শন ভেদান্তের “যত্ মত্ তত্ ভাব” এর সাথে মিলে যায়।

কর্ম অস্বীকার করা জীবনকে অস্বীকার করা। যা করেছি, তা আমার সত্য। দোষারোপে লাভ নেই, কারণ কান্টের মতে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা তাকে নতুন পথ চয়ন করতে দেয়। যদি সৃষ্টি আনন্দদায়ক না হয়, তাহলে নতুন চিন্তার মাধ্যমে তা পরিবর্তন করি। জীবন থাকলে চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত। প্রতিটি নতুন চিন্তা আমাদের নতুনভাবে গড়ে তোলে, যেমন নীটশের “অনন্ত পুনরাবৃত্তি”তে মানুষ নিজেকে পুনর্নির্মাণ করে।

আমাদের বর্তমান অতীতের চিন্তার ফল। আমরা যা ভাবি, তাই ঘটে। মৃত্যুর চিন্তা মৃত্যু আনে, পুনর্জন্মের চিন্তা পুনর্জন্ম দেয়। যে নিজেকে পতিত ভাবে না, তার পতন হয় না—এই দর্শন সুফি আত্মোপলব্ধির মতো, যেখানে চিন্তাই সত্তা নির্ধারণ করে। মুক্ত চিন্তা মুক্তি দেয়, মুক্ত শব্দ যুক্ত করে। সর্বোচ্চ সত্য, সৌন্দর্য, মহত্ত্বের চিন্তা করি, তাহলে জীবন তাই হয়ে ওঠে, যেমন অ্যারিস্টটলের “সুখ” চিন্তার ফল।

যা চাই, তা পাওয়ার চিন্তা করি, কথা বলি, কর্ম করি। সচেতন না হলে, অসচেতন চিন্তা জীবন গড়ে। প্রতি মুহূর্তে আমরা সৃষ্টি করছি। চিন্তার স্বচ্ছতা দরকার—কেবল যা চাই, তাই ভাবি। একচিন্তা চিন্তার শিখর, যেমন যোগ দর্শনে একাগ্রতা মুক্তির পথ। অন্য সম্ভাবনা বিচলিত করে।

চিন্তা নিয়ন্ত্রণ কঠিন নয়—পর্যবেক্ষণ ও মগ্নতার কৌশল। চিন্তাকে নিরীক্ষণ করি, শ্রেণিবদ্ধ করি। “আমি পারি”—এই বিবৃতি বিশ্বের শক্তিশালী, যেমন হেগেলের চিন্তা বাস্তবতা সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে ক্রিয়া যুক্ত করলে তা বাস্তব হয়।

বেশিরভাগ চিন্তা আমাদের নয়—পরিবেশ, পূর্বধারণা, অন্যের কথা মন নিয়ন্ত্রণ করে। একান্ত নিজের চিন্তা কি আছে? স্ব-কর্ম থেকে স্ব-চিন্তার জন্ম হয় কি? এই প্রশ্ন সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী স্বাধীনতাকে জাগায়।

চিন্তা থেকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তা। অশান্ত চিন্তা অশান্তি আনে, শান্ত চিন্তা শান্তি। চিন্তা মেঘের মতো পরিবর্তনশীল। প্রশ্ন চিন্তাকে ব্যস্ত রাখে, উত্তর লুকিয়ে যায়—যেমন জেন দর্শনে প্রশ্ন চিন্তাকে অতিক্রম করে।

নিয়ন্ত্রিত চিন্তা বাস্তবতা সৃষ্টি করে, অনিয়ন্ত্রিতও তাই। যৌথ চিন্তা যৌথ বাস্তবতা গড়ে, যেমন প্লেটোর গুহা অভ্যাস যৌথ মায়া। যাদের চিন্তা অনিয়ন্ত্রিত, তাদের জীবন তাই—তারা যৌথ বাস্তবতায় নির্ভর করে।

মানুষ চিন্তাশীল। চিন্তা থেকে ধর্মের উৎপত্তি। ধর্ম পালনের নয়, অতিক্রমের—যেমন কৃষ্ণমূর্তির মতে, সত্য চিন্তাহীন। চিন্তা ও আবেগের সামঞ্জস্য সচেতনতায়। আমরা কীভাবে ভাবি, অনুভব করি—তা পর্যবেক্ষণ করি।

জগৎ আয়না—তাকালে নিজের চিন্তার প্রতিবিম্ব দেখি, যেমন হের্মেটিক দর্শনে “যথা উপরে, তথা নিচে”। চিন্তা তরঙ্গ হয়, শব্দ হয়, কর্ম হয়, অভ্যাস হয়, চরিত্র হয়, নিয়তি হয়। চিন্তা অস্তিত্বের মূল। আমরা যা ভাবি, তাই হই। চিন্তা শক্তির রূপান্তর করে, সৃষ্টি করে। একনিষ্ঠ চিন্তা বাস্তব করে, যেমন কোয়ান্টাম দর্শনে পর্যবেক্ষক চিন্তা বাস্তবতা নির্ধারণ করে।

চিন্তা, শব্দ, কর্ম যখন আত্মনিয়ন্ত্রিত, তখন জন্ম নেয় আত্মজ্ঞান—যা কোনো অবলম্বন ছাড়া উদ্ভাসিত, সত্যের স্বরূপে, যেমন অদ্বৈত বেদান্তে আত্মজ্ঞান চিন্তার অতীত।

– ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ