বিশ্বাসের অন্ধকার
বিশ্বাস যদি শুধু একটি কথা হয়, তাহলে তা কেন কখনও পূর্ণতা পায় না? একটি ভাবনা যদি সত্যি হতো, তাহলে সেটি মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করত। কেবল মুখে উচ্চারিত বিশ্বাসে কি পৃথিবী বদলে যায়? যদি বদলাতো, তাহলে কেন এখনো মানুষের মধ্যে যন্ত্রণা, দুঃখ, লোভ ও ঘৃণা রয়ে যায়? বিশ্বাস যদি সত্যি হতো, তবে কেন সমাজের অন্ধকার দিকগুলি খোলাসা হতে থাকে, যেখানে মানুষ প্রতারণা করে, দ্বিধা এবং বিভাজন ছড়িয়ে দেয়?
যদি কেউ সত্যিই বিশ্বাস করত, তবে তাকে কি কখনো আশীর্বাদে, অর্থের লোভে, বা পুরস্কারের জন্য স্বার্থপরতায় মগ্ন থাকতে দেখা যেত? ধর্মের উদ্দেশ্য কি শুধু আধ্যাত্মিক মহিমা বা একান্ত শ্রদ্ধায় পূর্ণ নাকি এটি পুরস্কারের ভীতি, পরকালের কল্পনা ও মানবিক দুর্বলতা থেকে পালানোর বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে? যদি ঈশ্বরের শক্তি, ক্ষমতা, এবং আদালতে বিশ্বাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ উপলব্ধি থাকতো, তবে সবার জীবন কি তা অনুযায়ী ছন্দময় হত?
যে ব্যক্তি দিনের শেষে সব কিছু অস্থায়ী বলে মনে করে, সে কেন জীবনের পেছনে এতটা তৃষ্ণিত থাকে? কেন সে আধিকারিকদের এবং সমাজের মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে, অথচ নিজে সত্যের সন্ধান করতে চেষ্টা করে না? পৃথিবী যা দেখাচ্ছে, তাতে মানুষের বিশ্বাস শুধু বাহ্যিক রূপ নেয়, ভিতরের গভীরতা কোথাও বিলীন হয়ে যায়। বিশ্বাস শুধু মুখে থাকে, আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভয়, অশান্তি, আর সম্পদের প্রতি অস্থিরতা।
যে ব্যক্তি প্রকৃতই বিশ্বাসী, সে কি কখনো তার বিশ্বাসের উপরে প্রশ্ন তুলবে? যদি ঈশ্বরের শক্তি এতটাই অনন্ত ও অসীম হয়ে থাকে, তবে কেন তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য এত উপকরণের দরকার? কেন মানুষের মধ্যে শাসক আর শোষকের বিভাজন, হিংসা আর অসন্তুষ্টি অব্যাহত থাকে, যদি তারা আধ্যাত্মিক জগতে বিশ্বাসী হতো?
এটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে, মানুষ কেবল ধর্মীয় রীতি ও বিশ্বাসের খোলস তৈরি করে, কিন্তু একে বাস্তবে ধারণ করে না। তারা ভাবে ধর্ম তাদের কল্পনা ও রীতি অনুসারে চলবে, কিন্তু যখন জীবন তাদের কাছে আসে বাস্তবতার কঠিন প্রশ্ন নিয়ে, তখন তাদের বিশ্বাস থাকে কেবল শব্দ, কিছু অজানা মন্ত্র এবং আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে। তবে কেউ কি আসলেই বিশ্বাস করে যে আধ্যাত্মিক মুক্তি আর পরকাল তাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হতে পারে? অথবা তাদের আস্থা প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে উদ্ভূত?
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের কথা বলে, কিন্তু তার আচার-ব্যবহার প্রতিনিয়ত অন্যথায় প্রমাণিত হয়, সে আসলে বাস্তবে কী বিশ্বাস করে? আর যখন সে পৃথিবীর আনন্দ ও মায়া-লীলায় ডুবে থাকে, তখন সে কী ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি সত্যি বিশ্বাসী? না, তার বিশ্বাস কেবল স্বার্থপরতা, ভয়ের শিকার, ও সস্তা আশ্বাস।
এটি যে সমাজের এক বড় দোষ, তা ঠিক বললে ভুল হবে না, যেখানে আমাদের বিশ্বাস শুধু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু অন্তরে কোনো পরিবর্তন আসে না। যা আমরা দেখি, তা যেন স্রেফ অভিনয়ের খেলা। একে বলা হয় মিথ্যাচারের তাপ—এটিই আমাদের “বিশ্বাসের” বাস্তবতা, যা শুধু কল্পনা ও দৃষ্টিভ্রমে পূর্ণ।
-ফরহাদ ইবনে রেহান
০৩/০৩/২০২৫ইং