ধর্ম ও নারী

ধর্ম ও নারী

একটি সমাজের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি নির্ধারণে নারীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ইসলামের সূচনালগ্নে নারীর অংশগ্রহণের গৌরবময় ইতিহাস যেভাবে আধুনিক যুগে নারীদের ভূমিকা ও অধিকার পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, তেমনি আমাদের কাছে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, নারী কেবল গৃহিণী নয়, বরং সমাজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা, যিনি ইসলামের প্রাথমিক পর্বের একটি অমূল্য রত্ন, যাঁর জীবন ছিল দৃঢ় সাহস, নিষ্ঠা ও ভালবাসায় ভরা।

৬১৯ খ্রিস্টাব্দে যখন মক্কায় নবী মোহাম্মদ (সঃ) প্রতি শত্রুতা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছিলেন, তখন খাদিজা তাঁর সাহস ও সম্পদ দিয়ে নবীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মক্কায় ইসলাম প্রচারের প্রথম খরচ বহন করেছিলেন তিনি, তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে। খাদিজা যখন জীবিত ছিলেন, তখন মক্কায় নবীকে বিতাড়িত করার সাহস কেউ পায়নি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর মাত্র তিন বছর পরেই নবী মোহাম্মদকে মক্কা ছেড়ে মদীনায় যেতে হয়। নবীর মুখে একথা শোনা যায়, “আজ যদি খাদিজা থাকতো, তবে আমাকে দেশ ছাড়তে হতো না।”

এখানে খাদিজার অবদান কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নবীকে শিখিয়েছেন ব্যবসা, রাজনীতি, এবং জীবনকে বিচক্ষণভাবে পরিচালনা করার কৌশল। খাদিজা যেমন একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সফল, তেমনি একজন ধর্মপ্রেমী ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে অসীম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

কিন্তু আজকের দিনে, যখন ইসলামের কাঠামোকে কিছু লোক তাদের স্বার্থে ব্যাখ্যা করছে, তখন নারীর প্রতি অন্যায় ও অবিচারের প্রাধান্য বেড়ে গেছে। নারীরা সমাজে যখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের কণ্ঠস্বরকে যখন চাপা দেওয়া হয়, তখন সেই ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী হয়ে ওঠে। এই ধরনের হেনস্থা, নিপীড়ন এবং নারীর প্রতি অবমাননা ইসলাম বা কোনো ধর্মের মূল শিক্ষা নয়। মুসলিম নারীদের যদি ঐতিহাসিকভাবে খাদিজার মতো মহান আদর্শের পথে চলতে না দেওয়া হয়, তবে সেটা সেই ধর্মের প্রতি অবিচার ও দুর্ব্যবহার।

এখনকার সমাজে যেখানে নারীর অবস্থান কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে খাদিজা, যিনি ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নবীর অবিচ্ছিন্ন সহযাত্রী, তার জীবন আমাদের কাছে একটি মহান দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, এবং ধর্মীয় সহায়ক। তিনি কখনো মুখ ঢেকে চলাফেরা করেননি, মক্কার বাজারে যেতেন, বাণিজ্যিক আলোচনায় পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতেন এবং ব্যবসায়িক জীবনে যথেষ্ট সফল ছিলেন। তার জীবন একান্তভাবে প্রমাণ করে যে, নারীর স্থান সমাজের সকল ক্ষেত্রে সমান, বিশেষত ধর্মীয় ক্ষেত্রে।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। কিছু ধর্মীয় মতবাদ, যেগুলি সমাজে নারীদের পদমর্যাদাহীন করতে চায়, তা অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সৃষ্টিকর্তা কখনোই তার সৃষ্টির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেননি, বরং তিনি মানবতার প্রতি, বিশেষ করে নারীর প্রতি সঠিক স্থান ও অধিকার দিয়েছেন। ১৫০০ বছরের মধ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবিকতার কোনো সময়সীমা নেই, বরং আমরা যদি ঐতিহাসিক সত্য, ধর্মীয় শিক্ষা এবং মানবাধিকারকে একত্রে সম্মান করি, তবে আমরা সমাজে এগিয়ে যাব, যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান অধিকারী হয়ে, একে অপরকে সহযোগিতা করবে এবং ধর্মীয় ও মানবিক সমাজের পথে এগিয়ে যাবে।

ধর্ম কেবল মানুষের নৈতিক দিকটি তুলে ধরার জন্য নয়, বরং সকল স্তরের মানুষকে শান্তি, সহমর্মিতা এবং ন্যায়ের দিকে পরিচালিত করার জন্য। ধর্মে নারীর অবস্থান এই সময়েও ঐতিহাসিক রূপে গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেই অবস্থানকে যদি আমরা শুধু আলাদা করে, শুধুমাত্র পুরুষের আধিপত্যের চোখ দিয়ে দেখি, তবে আমরা ঐ ধর্মের পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হবো।

বিশ্বের প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে, বিশেষত নারীদেরকে সম্মান, ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সমবেদনার সঙ্গে আচরণ করার শিক্ষা রয়েছে। আজকের সময়ে, আমরা যদি ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নারীর প্রকৃত মর্যাদার পথে চলতে দিতে পারি, তবে সমাজে শোষণ বা হেনস্থা নয়, বরং সমানাধিকার ও মানবিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

– ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel