অন্ধ অবিশ্বাসী এবং ধর্মের প্রতি নির্বিকার দৃষ্টি
অবিশ্বাসী, বা যে ব্যক্তি ধর্মের প্রতি মনোযোগী নয়, অনেক সময় নিজের অবিশ্বাসের মানে বুঝতে ব্যর্থ হয়। আধুনিক সমাজে অবিশ্বাসের চেহারা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে, যদিও এটি অনেক সময় অন্ধ অবস্থায় দেখা যায়। আধুনিকতার চাহিদা কিংবা বৈজ্ঞানি প্রভাব ধর্মীয় চিন্তাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু, আসল প্রশ্নটা হলো, অবিশ্বাসী আসলে কি ধর্ম বা ঈশ্বরকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে চায়, নাকি তাদের অন্ধ অস্বীকার সমাজে নতুন ধরনের বিপ্লবের নাম?
অবিশ্বাসী মনোবৃত্তির শেকড়
অবিশ্বাসী এক ধরনের চিন্তা যা দিয়ে ধর্ম বা ঈশ্বরকে খারিজ করে, তার ভিত্তি মূলত এক ধরনের নির্দিষ্ট মানসিকতার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক সময়, এর সঙ্গে থাকে ঈশ্বরের প্রতি অনুশোচনা কিংবা পুরোনো বিশ্বাসের প্রতি ক্রোধ। আধুনিক সমাজে ধর্মকে অনেকেই একটি পুরানো বিশ্বাস বা কুসংস্কার মনে করেন, যা এখন আর মান্যতা পায় না। ধর্মের প্রতি এই বিরূপ দৃষ্টি মূলত বিজ্ঞান ও যুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলাফল।
ধর্মের প্রতি আক্রমণ শুধু এক ধরনের ধর্মীয় গঠন কিংবা আচার-ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা নয়, বরং এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া, যা মানুষের অন্তর্নিহিত অনুভূতির গভীরতা এবং বিশ্বাসের শক্তি থেকে বিচ্যুত। এই ধরনের ব্যক্তিরা বেশিরভাগ সময় নিজেদের চিন্তাশক্তিকে বিজ্ঞান এবং যুক্তির হাতে তুলে দেয়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে।
রুশদি এবং অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি
সালমান রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বইটি একদিকে যেমন কিছু মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসে আঘাত হানে, তেমনি অন্যদিকে কিছু মানুষের কাছে এটি একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সমালোচনা ও বিশ্বাসের প্রশ্ন। তবে, অনেকেই এই বইটি পড়ে না, কিংবা কোনো যুক্তির ভিত্তিতে তা বিশ্লেষণ করে না, তারা কেবল শুনেছে যে এতে ধর্মের অবমাননা রয়েছে। আবার অনেকেই এই বইটি উত্থাপন করে নিজেদের চিন্তার মুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু সবার আগে, এই সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যুক্তির অভাব প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্পষ্ট।
এখানে একটা মূল তত্ত্ব দাঁড়িয়ে থাকে, যা হল—বেশিরভাগ অবিশ্বাসী ব্যক্তি ধর্মীয় যুক্তির অভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। যখন তারা কোনো ধর্মীয় বই বা ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে জানতে চায় না, কিংবা যুক্তির মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করতে চায় না, তখন তাদের অবিশ্বাস কেবল অন্ধতারই এক রূপ হয়ে দাঁড়ায়।
বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক
অবিশ্বাসী ব্যক্তিরা অনেক সময় বিজ্ঞানের নাম করে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে, কিন্তু তাদের কাছে বিজ্ঞান সবসময় ধর্মের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে এমন একটি ধারণা গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞান এবং ধর্ম কখনো একে অপরের বিরোধী নয়। বিজ্ঞান হলো প্রকৃতির কাজকর্ম ও তার নিয়মাবলী সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি, আর ধর্ম হলো আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে জীবনের উদ্দেশ্য। বিজ্ঞান আমাদের এই পৃথিবী এবং তার নিয়মাবলী সম্পর্কে জ্ঞান দেয়, তবে ধর্ম আমাদের আত্মার দিক, জীবন-মৃত্যু ও মহাজগতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।
অন্ধ অবিশ্বাসী, অন্ধ ধর্মান্ধতা এবং সমাজ
অন্ধ অবিশ্বাসী এবং অন্ধ ধর্মান্ধতা—দুটিই সমানভাবে ক্ষতিকর। যেখানে একপক্ষ অন্ধভাবে ধর্মকে অস্বীকার করে, অন্যপক্ষ আবার অন্ধভাবে ধর্মের নামে অত্যাচার চালায়। উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, কারণ উভয়ই অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। ধর্মান্ধতা সমাজে অত্যাচারের জন্ম দেয়, আর অবিশ্বাসী মনোভাব এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়, যা মানুষকে অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়।
অবিশ্বাসীরা যদি শুধুমাত্র নিন্দা, আক্রমণ, বা বিদ্রুপের মাধ্যমে ধর্মের সমালোচনা করে, তবে তারা আসলে কোনো ধর্মীয় দর্শন বা সত্যের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি খোলামনে ও সৎভাবে ধর্মকে বিশ্লেষণ করে, শুধুমাত্র তখনই সে ধর্মের সত্যতা খুঁজে পেতে সক্ষম হতে পারে। ধর্মের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার আগে, একজনকে ধর্মের গভীরতা, তার মূল তত্ত্ব, এবং দর্শনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝতে হবে।
শেষ কথা
অবিশ্বাসী ও ধর্মান্ধদের মধ্যে পার্থক্যটা একেবারেই সূক্ষ্ম, কারণ উভয়েই নিজেদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী এবং জীবনকে দেখতে চায়। প্রকৃত জ্ঞান ও মুক্তি তখনই আসে, যখন আমরা নিজের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে খোলামনে পরীক্ষা করে দেখি, এবং তা পুরোপুরি যুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির সাথে মিলিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারি। একমাত্র সত্যিকার উপলব্ধি, যার মধ্যে যুক্তি এবং আধ্যাত্মিকতার সম্মিলন থাকবে, আমাদেরকে সত্যিকার মুক্তি এবং শান্তি দেবে।
— ফরহাদ ইবনে রেহান