কালিমার হাকিকত।

কালিমার হাকিকত।

কোরানের ১৪নং সুরা ইব্রাহিমের ২৪,২৫,২৬ ও ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন: “আলাম কাইফা দ্বারাবাল্লাহু মাছালান, কালিমাতান তাইয়্যিবাতান কাশাজারাতিন তাইয়্যিবাতিন আদুলুহা হাবিতুউ ওয়া ফারউহা ফিচ্ছামায়ি।” অনুবাদ:- “আপনি কি লক্ষ্য করেন নাই আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়া থাকেন? পবিত্র বাক্যের তুলনা পবিত্র বৃক্ষ, যাহার মূল সুদৃঢ় ও যাহার শাখা- প্রশাখা অসীম আকাশে বিস্তৃত।”

“তুতীউকুলাহা কুল্লা হামিন বিইজনি রাব্বিহা ওয়া ইয়াদ্বরিবুল্লাহুল আমছালা লিন্নাসি লাআল্লাহুম ইয়াতাজাক্কারুন।” অনুবাদ:- “যাহা প্রত্যেক মউসুমে উহার ফলদান করে উহার রবের অনুমতিক্রমে। এবং আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়া থাকেন। যাহাতে তাহারা ধ্যান করিতে পারে।”

“ওয়া মাছালু কালিমাতিন খাবিসাতিন কাশাজারাতিন খাবিসাতি নিজ্বতুচ্ছাত মিন ফাউকিল আরদ্বি মালাহা মিন ক্বারার।” অনুবাদ:- “কালিমায়ে খবিসা তথা খবিস বাক্যের উপমা এক খবিশ বৃক্ষ, যাহার মূল ভূ- পৃষ্ঠ হইতে বিচ্ছিন্ন; যাহার কোন স্থায়িত্ব নেই।”

“ইউছাব্বি তুল্লাহুল্লাজিনা আমানু বিল কাউলিচ্ছাবিতি ফিল হাইয়্যাতিদ্দুনিয়া ওয়া ফিল আখিরাহ; ওয়া ইউদ্বিুল লাহুজ্জালিমীনা ওয়া ইয়াফ আলুল্লাহু মাইয়াশাউ।” অনুবাদ:- “যাহারা সার্বজনীন বানীতে ঈমান আনে তাহাদেরকে ইহজীবনে এবং পরজম্মে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখিবেন এবং যাহারা জালিম আল্লাহ উহাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখিবেন। আল্লাহ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।”

ব্যাখ্যা:

উপরের উল্লিখিত চারটি আয়াতের রচনাশৈলীর মর্মার্থ খুবই অপূর্ব এবং চমৎকার। এবং সর্বোকৃষ্ট শিল্পগুণ সমৃদ্ধ তীর্যক বাক্য। সাহিত্যিক ভাবধারায় ব্যঞ্জনাময়। উল্লিখত আয়াতগুলোর ভাবাদর্শন গভীরের চেয়েও গভীতর।কোনো রহস্যপূর্ণ তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন বিষয় অবতারণা করতে গেলে রূপকার্থে তথা উপমার আশ্রয় নেওয়া হয়। সত্যদর্শনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই রূপকতার পোশাকের আড়ালে মুড়িয়ে রাখায় হয়। যাতে করে আম জনতা সহজে বুঝতে না পারে। আম সর্বকালেই আম, আর খাস সর্বকালেই খাস। জ্ঞানীগণ যাতে জ্ঞান গবেষণা করে সত্যদর্শনটুকু উৎঘাটন করতে পারেন।জ্ঞানীগণ রহস্য উদঘাটন করতেই অভিপ্রেত। জ্ঞানীগণ চুষা আমের ন্যায় বাক্যকে চিবিয়ে চিবিয়ে রস বের করে বাক্যসুধা আস্বাদন করেন।

আমরা কোরানিক দর্শন আলোকে জানতে পারলাম কালিমা দুই প্রকার, যথা:- কালিমায়ে তাইয়্যিবা ও কালিমায়ে খাবিসা। অর্থাৎ পবিত্র বাক্য এবং অসার তথা ফায়েশাপূর্ণ বাক্য।

এই কালিমাকে উপমা দেওয়া হয়েছে একটি প্রাচুর্যশালী পরিপূর্ণ বৃক্ষের সাথে। এবং এই উৎকৃষ্ট তথা পবিত্র বৃক্ষটিকে কালিমায়ে তাইয়্যিবার তীর্যকতা প্রদর্শন করা হয়েছে। কালিমায়ে তাইয়্যিবার মেজাজি রূপটি হল- “সৎবাক্য” অর্থাৎ “লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। এবং পবিত্র বৃক্ষটি হল জাগ্রত রূহের অধিকারী একজন পবিত্র মানবসত্তা। যিনি রূহুল কুদ্দুসের ধারক ও বাহক পবিত্র মানব বৃক্ষ।

এই জাগ্রত রূহের আধারকে কোরানিক দর্শনে রব তথা আদম বলা হয়েছে। এই জাগ্রত রূহের অধিকারী পবিত্র মানব বৃক্ষ আল্লাহর আমরা (নাহনু) দলের সদস্য। এই রূহরূপী রব আমরারূপে রেজেক বন্টন, কেতাব নাজেল, হেদায়েত দান ও রূহফুৎকারের কাজ করে থাকেন, যুগ থেকে যুগান্তরে। ইহাই আল্লাহর মনোনিত দ্বীনের সার্বজনীন বিধান। মৌমাছি যতকাল থাকবে পৃথিবীর বুকে ততকালই মধু সংগ্রহ করার জন্য মৌচাক বানাবে। ইহাই মৌমাছির তকদীর।

তাই মহাকবি আল্লামা ইকবাল রহ: বলেছেন- “খুদিকা সিররে নিহা লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু” অর্থাৎ- তোমার আপন সত্তার মধ্যে সকল রহস্যের রাজ অন্তর্নিহিত রয়েছে, শুধুমাত্র অহংকারের পর্দাটা উঠিয়ে দেখ স্বয়ং লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু তোমার মধ্যে মূর্তিমান রূপে উদ্ভাসিত। একজন আত্মার বিজ্ঞানীই পবিত্র বৃক্ষ। এই বৃক্ষ হতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা- প্রশাখা বিস্তৃত হতে থাকে। যেমন মহাপ্রভু মহানবী সা: হলেন উম্মুল কিতাব। অর্থাৎ সকল কিতাবের মাতা। তিনি কোরানুল কারিমের মাতা, তিনি কোরানুল মজিদের মাতা, তিনি কোরানুল হাকিমের মাতা, তিনি কোরানুল মুবিনের মাতা, তিনি কোরানুল ফুরকানের মাতা। নূরী মুহাম্মদী হল সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের মাতা আল কাউসারের মালিক। এই নূরী মুহাম্মদী সত্তাই হল প্রাচুর্যময় পবিত্র বৃক্ষের সদৃশ।  নূরী মুহাম্মদী সত্তার প্রাচুর্যের ধারা তথা আল কাউসারের প্রবাহমান বীর্যের ধারা যুগ থেকে যুগান্তরে সিনা ব-সিনা বিস্তৃত হতে থাকে।

সুফি কবি সাধক শাহজাহান শাহ আঃ বলেন- “দেখেছি কুমাইয়া পোকা, অন্য পোকা আনে ধরে, বাসায় রাখে পোপন করে, আপন রঙ্গে মিশলে পরে বাহির করে। বীজের গুণে ফল হয় না, দেখনা কাকরোল গাছ রোপন করে, শাস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা হয় না, উস্তাদ তুমি না ধরিলে। গুরুর জিহ্বা শিশ্যের কর্ণ বীজমন্ত্র লাগাইতে হয়, যেই ফল খাইলে অমর হইবে আমল করে খাইতে হয়, লিঙ্গ – যোনী সঙ্গম হলে আচানক এক ফল ধরিবে, কামভাবে লিল্ত হলে ফলে মূলে বিনষ্ট হবে।”

পবিত্র বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে মানুষকে সেবা দিয়ে যায়। আর অপবিত্র বৃক্ষ ধ্বংস হয়ে যায়।মন্দ বাক্য বা মন্দ লোকের সংস্পর্শে থাকলে স্বভাবের পরিবর্তন হবে না। কলবের পর্দা উন্মুক্ত হবে না, কলবের পর্দা উন্মুক্ত করতে হলে পবিত্র বাক্য পাঠ ও পবিত্র মানবের ধ্যান করতে হবে। খান্নাস প্রকৃতির মানুষ কালিমায়ে খবিসার অন্তর্ভুক্ত। আর মুমিন ও আমানু কালিমায়ে তাইয়্যিবার অন্তর্ভুক্ত। এই কালিমায়ে তাইয়্যিবাকে তুলনা করা হয়েছে উৎকৃষ্ট বৃক্ষের সাথে যা কোরানের ২৪ নং সুরার ৩৫ নং আয়াতের সাথে সংগতিপূর্ণ।

“আল্লাহ আকাশমন্ডলী তথা মনোজগতের ও পৃথিবীর তথা দেহজগতের নূর। আল্লাহর নূরের উপমা যেন একটি দীপাদার যাহার মধ্যে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ; ইহা প্রজ্বলিত করা হয় পূত-পবিত্র যায়তূন বৃক্ষের তৈল দ্বারা, যাহা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়, অগ্নি উহাকে স্পর্শ না করলেও যেন উহার তৈল উজ্জ্বল আলো দিতেছে, নূরের উপরে নূর।আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করেন তাহার নূরের দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়া থাকেন এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ে, সর্বজ্ঞ।”

সুতরাং সবকিছুর মূল হলো নূরে মুহাম্মাদী নূর। এই নূরের সাথে যার সম্পর্ক রয়েছে তিনিই সঠিক পথে সুপ্রতিষ্ঠিত। যার এই নূরের সাথে সম্পর্ক হয় নাই তিনিই আপন নফসের উপর জুলুমকারী জালেম।তাই কবি বলেন- “মানুষ ছাড়া ক্ষেপা রে তুই মূলহারা, তথা কালিমায়ে খবিসা।”

দেহতত্ত্ব

কি আশ্চর্য এক ফল গাছ,
লাগাইল হাওয়ার উপরে-
হাওয়া যেদিন থাকিবেনা,
গাছ মরিবে একেবারে।
প্রাকৃতিক সার দিয়া,
বাড়াইতেছে গাছ অক্মিজেন
হাইড্রোজেন খাওয়াইয়া-
কার্বণ- ডাই অক্সাইড
তোমার হাতে রাখিয়া,
তাই নিত্য নতুন রং ধরে।
ডাল পাতা গাছ বাড়লে,
ফুল ফুটে এই সংসারে-
পরাগায়ণ না হইলে পরে,
ফল ধরে না ফুল ঝড়ে পড়ে।
পরাগরেণু যেই ফুলে ভরিল,
সেই বৃক্ষে ফল ধরিল-
আলিফ লাম মীম ফল ধরিল,
খাইতে চায় সবাই কৌশল করে।
যেই বৃক্ষে ফল নাই,
কেউ ভালবাসেনা তাই-
আসা যাওয়া সবই বৃথা তাই,
স্মৃতি রয়না ভিডিও করে।
ইসমে আজম নাম দিয়া,
গাছে দিছ শীল মারিয়া-
শাহজাহান গাছ গেছে তোমার হইয়া,
দেখতে আছে বিশ্বজুরে।

আদম তত্ত্ব

সু-বৃক্ষে অমূল্য এক ফল ধরিল,
মানব সৃষ্টির শ্রেষ্ট হইল-
যেই বীজেতে গাছ হইল,
সেই বীজেতে খন্ডবিখন্ড হইল।
বিকারে যেই ফল ধরে,
ঠিক থাকে না ঝড়ে পড়ে-
নিষবিকার না থাকিলে,
ফলে মূলে বিনাশ হইল।
প্রেম ভাবের একটি ফল,
খাইছে যারা হইছে উজ্জ্বল –
অখন্ড থেকে রাখছে ফল,
চিরদিন অমর রইল।
আব্দুল্লাহ আমেনায় মিলন হইল,
চাঁদের গায়ে দাগ লাগিল-
আগের রং বদলায়ে গেল,
ইউসুফ অখন্ড রইল।
ওয়াজকুরুনী সেই ফল খাইয়া,
পূর্ণশক্তি গেল পাইয়া-
ইদ্রিস নবী বেহেশতে গিয়া,
অমর হইয়া চিরদিন রইল।
আবহায়াতের পানি খাইল,
খোয়াজ খিজির জিন্দা রহিল-
ইসমে আজম নিজে হইল,
মনসুর পুড়েও আল্লাহ কইল।
শাহজাহান কয় কাসেম মিয়া,
সুরাবান তহুরা যাও খাইয়া-
আচানক এক ফল ধরবে যাইয়া,
ক্ষুদ্র বস্তু দীল মোহাম্মদ শ্রেষ্ঠ হইল।

(সংযমের সংবিধান: সাধক শাহজাহান শাহ আঃ)

– আর এফ রাসেল আহমেদ

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel