সত্যের অন্বেষণ

সত্যের অন্বেষণ

যুক্তির অগ্নিপরীক্ষায় সন্দেহের দীপ্তি। সত্য সেই অপরিবর্তনীয় সত্তা, যার স্বরূপে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, কোনো সংশয়ের ছায়া নেই। কিন্তু সত্যের দিকে যাত্রা শুরু হয় সন্দেহের আলোকে—কারণ সন্দেহ সত্যের শত্রু নয়, বরং তার অপরিহার্য সহযাত্রী। সন্দেহ ছাড়া সত্যান্বেষণ অসম্ভব, যেমন অন্ধকার ছাড়া আলোর মূল্য বোঝা যায় না। সন্দেহ প্রমাণের দাবি জাগায়, এবং প্রমাণ সন্দেহকে নিরস্ত করে সত্যের ভিত্তি মজবুত করে। কিন্তু প্রমাণকে সন্দেহ করা মানে নিজের যুক্তিবোধকেই অস্বীকার করা—কারণ যুক্তি প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। যদি প্রমাণকে সন্দেহ করি, তাহলে আমরা জ্ঞানের সমগ্র কাঠামোকেই ভেঙে ফেলি।

অদৃশ্যকে সুন্দর বলে গ্রহণ করা বা অন্যের কথাকে অটল সত্য মেনে নেওয়া—এটি সত্যান্বেষণের পথে সবচেয়ে গভীর প্রতিবন্ধক। কারণ, এতে আমরা নিজের যুক্তিকে পরিত্যাগ করে অন্ধ অনুসরণ করি। ‘আমি জানি মৃত্যুর পর কী ঘটবে’ বা ‘আমি ঈশ্বরকে দেখেছি’—এই দাবিগুলো অপ্রমাণযোগ্য বলে দৃঢ়ভাবে বলা যায়, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এগুলো সত্য। অপ্রমাণযোগ্যতা সত্যের প্রমাণ নয়; এটি কেবল যুক্তির সীমার ইঙ্গিত। যা প্রমাণ করা যায় না, তাকে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না—কারণ সত্য প্রমাণের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, অন্ধকারে নয়।

জানার কৌতুহল সকলের মধ্যে জাগে, কিন্তু বোঝার সামর্থ্য কেবল যুক্তিবাদীর। যে বলে ‘আমি জানি’, সে প্রায়শই শুধু শুনেছে বা পড়েছে, কিন্তু বোঝেনি। সত্য জানা নয়, বোঝা—এবং বোঝার জন্য প্রয়োজন যুক্তির অগ্নিপরীক্ষা। অধিকাংশ মানুষ শোনা কথাকে সত্য বলে গ্রহণ করে, কারণ প্রশ্ন করা তাদের কাছে বিদ্রোহ। কিন্তু যে প্রশ্ন করে না, সে জ্ঞানের দরজায় দাঁড়িয়েও ভিতরে প্রবেশ করে না। প্রশ্নহীন মন নির্বোধ—কারণ এটি যুক্তির মৃত্যু।

সুন্দর, সৎ, আন্তরিক, উদ্যমী হওয়া মানুষকে জ্ঞানী করে না। ভালোমানুষের কথা সত্য বলে গ্রহণ করার কোনো যুক্তি নেই। একজন সৎ ব্যক্তিও বলতে পারেন, ‘ঈশ্বর আছেন’, ‘পুনর্জন্ম আছে’, ‘স্বর্গ-নরক আছে’—কিন্তু তিনি কীভাবে জানলেন? বইয়ে পড়ে? অন্যের মুখে শুনে? না কি নিজের যুক্তিতে পরীক্ষা করে? যদি না পরীক্ষা করেন, তাহলে তাঁর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, যতই সৎ হোন না কেন। সত্যের মাপকাঠি সততা নয়, প্রমাণ। সততা সত্যের পথ দেখাতে পারে, কিন্তু সত্য নিজেই নয়।

সত্যকে অবশ্যই যুক্তির অগ্নিপরীক্ষায় জ্বালাতে হবে। যদি সত্য সত্যই হয়, তাহলে আগুনে তার দীপ্তি বাড়বে, ছাই হবে না। যা প্রমাণিত, তাই সত্য। বিশ্বাস প্রমাণের বিকল্প নয়। প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস একটি দুর্বল সেতু—যেকোনো যুক্তির ঝড়ে ভেঙে পড়ে। যুক্তি ছাড়া বিশ্বাস অন্ধকারে হাঁটা—যেখানে পতন অনিবার্য।

প্রশ্ন করো- এই সত্য কি সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য? এটি কি দশ হাজার বছর আগেও সত্য ছিল, এবং দশ হাজার বছর পরেও থাকবে? স্থান, কাল, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের আলোয় এর স্থায়িত্ব কতটুকু? যারা পরম সত্যের অন্বেষণ করে, তাদের জন্যও কি এটি অটল? বিজ্ঞানী যদি এটি পরীক্ষা করে, তাহলে কি ফল পাবে? প্রশ্ন করতে করতে মূলে পৌঁছাও—যেখানে আর সন্দেহ নেই, সেখানে প্রশ্নও নেই। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পথই হলো সন্দেহের সাহস এবং যুক্তির অগ্নিপরীক্ষা।

শৈশব থেকেই আমাদের মনে উত্তর ঢেলে দেওয়া হয়—প্রশ্ন জাগার আগেই। অধিকাংশ জ্ঞান শোনা কথা, পড়া বইয়ের লাইন। বারবার শুনতে শুনতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়, এবং প্রশ্ন করাকে পাপ মনে করে। কিন্তু প্রশ্নহীন মন নির্বোধ। যে প্রশ্ন করে না, সে সত্যের দাস নয়, মিথ্যার গোলাম। প্রশ্নহীনতা যুক্তির মৃত্যু, এবং যুক্তির মৃত্যু মানে সত্যান্বেষণের মৃত্যু।

উপাসনা থেকে গবেষণা উত্তম। প্রার্থনা থেকে চিন্তা উত্তম। যদি কেউ উপাসনা করতে চায়, তাকে বলো – গবেষণা করো। যদি প্রার্থনা করতে চায়, তাকে বলো: যুক্তি দিয়ে চিন্তা করো। কারণ, সত্য কোনো দেবতার দান নয়—এটি মানুষের যুক্তির ফল। যুক্তি ছাড়া উপাসনা অন্ধকারে হাঁটা, এবং প্রার্থনা ছাড়া চিন্তা শূন্য।

সত্যের পথে হাঁটতে গেলে সন্দেহকে সঙ্গী করো। প্রমাণকে অস্ত্র করো। বিশ্বাসকে পরীক্ষা করো। যেখানে প্রশ্ন শেষ হয়, সেখানে সত্য শুরু হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য যুক্তির অগ্নিপরীক্ষা অপরিহার্য। যুক্তি ছাড়া সত্যান্বেষণ অসম্ভব—কারণ সত্য যুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত হয়, অন্ধকারে নয়।

– ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ