সর্বশ্রেষ্ঠ সুরা- আল কাওসারের সুফিতাত্ত্বিক তাফসির।

সর্বশ্রেষ্ঠ সুরা- আল কাওসারের সুফিতাত্ত্বিক তাফসির।

সূরাঃ আল-কাওসার [108:1] :-

إِنَّآ أَعْطَيْنَٰكَ ٱلْكَوْثَرَ

উচ্চারণ: ইন্না আতাইনা-কা আল কাওসার।

অনুবাদ: নিশ্চয়ই আপনাকে আমরা কাওসার দান করেছি।

শাব্দিক বিশ্লেষণ: (ইন্না) নিশ্চয়ই আমরা, ( আ’তাইনাকা) আপনাকে দান করেছি ( আল কাওসার)
কল্যাণধারা, প্রাচুর্য, আধিক্য, নূরীবীর্যের ধারা, জান্নাতের অফুরন্ত রেজেক, আব হায়াতের ঝরণা,
অমৃতধারা, আউয়াল, আখের, জাহের, বাতেনের সকল বিষয়ে রহমতের পাত্রস্বরূপে।

সূরাঃ আল-কাওসার [108:2] :-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ

উচ্চারণ: ফা- সাল্লি লি- রাব্বিকা ওয়া আনহার।

অনুবাদ: সুতরাং আপনার রবের জন্য সালাত করুন এবং কোরবানি করুন।

শাব্দিক বিশ্লেষণ: ( ফা) সুতরাং ( সল্লি) সংযোগ স্থাপন করুন,যোগাযোগ চিরস্থায়ী করুন, সালাত করুন। (লি) জন্য, উদ্দেশ্য, নিমিত্তে। ( রাব্বিকা) তোমার রব, আপনার রব, আপনার প্রতিপালক, আপনার প্রভু। (ওয়া) এবং, ও, আর (আনহার) উৎসর্গ করো, কোরবানি করো, জবেহ করো।

সূরাঃ আল-কাওসার [108:3] :-

إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ ٱلْأَبْتَرُ

উচ্চারণ : ইন্না শানিয়াকা হুয়া আল- আবতার।

অনুবাদ : নিশ্চয়ই আপনার অসম্মানকারীরা শিকড় কাটা।

শাব্দিক বিশ্লেষণ: (ইন্না) নিশ্চয়ই, প্রকৃতপক্ষে, আসলেই ( শানিয়াকা) অসম্মান করা, টিটকারী করা, শত্রুতা করা, ঘৃণা করা, বিরাগ হওয়া । ( হুয়া) সে। ( আল আবতার) যার ( শিকড়) কাটা, লেজকাটা, মূল থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্বংশ, শাজারাহীন।

সুফিতাত্ত্বিকবিশ্লেষণ

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। আল্লাহ এই আয়াতে ‘আমি নাজেল করতাম’ বলেন নি – বলেছেন, ‘আমরা নাজেল করতাম’। এই ‘আমরা’কে প্রায় অনুবাদেই ‘আমি’ পাবেন। আর একটি কথা পাঠক ভাইদের লক্ষ্য করতে বলি যে, নাজেল করার সময়, হেদায়েত করার সময়, রেজেক বণ্টন করার সময়, রুহ ফুৎকারের সময় – ইত্যাদি কয়টি বিশেষ ক্ষেত্রে আপনি একবারও ‘আমি’ শব্দটি পাবেন না, অঙ্কের হিশাবের মতো ‘আমরা’ অবশ্যই পাবেন। ইহার সৌন্দর্য, এত বিস্ময়কর এই রহস্য যে, ইহার আলোচনা করতে গেলে তৌহিদ একেবারে উলঙ্গ হয়ে পড়ে। ইহার আলোচনা আল্লাহ চাহে তো করা হবে তবে এক কথায় প্রত্যেক আমরা-রূপী আল্লাহ আমি-আল্লাহর আমরার দলের সদস্য এবং প্রত্যেকে পূর্ণ হেদায়াতপ্রাপ্ত।

প্রকৃত প্রস্তাবে এই আমরার দলের সদস্যরাই ধর্মে দীক্ষিত করেন। কারণ, কেহই সহজে চান না বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করতে। ধর্মমত পড়তে এবং গবেষণা করতে একজন সহজেই এগিয়ে আসে, কিন্তু উহাকে বরণ করার প্রশ্ন উঠলেই প্রচন্ড আঘাতের প্রয়োজন। এই মানসিক প্রচন্ড আঘাত এক পীর-ফকির ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না ধর্ম গ্রহণের ইতিহাস এই কথাই আমাদেরকে জানিয়েছে। আমার এই অনুবাদ ও ব্যাখ্যার যুক্তি যত সুন্দরই হোক না কেন, হোক না যত বড় অকাট্য দলিল প্রমাণের দ্বারা প্রমাণিত, কিন্তু ইহার মূল্য চারটি পয়সাও আমি দেব না। যদি কোনো ওলিয়ে কামেল বলেন যে, ফজরের কোরান বলতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথাই বলা হয়েছে, তবে অবশ্যই উহা আমি মেনে নেব।

কারণ, আমার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা আমিত্ব ও স্বকীয়তার মধ্যে থেকে করা, ওলিয়ে কামেল যে রকম অনুবাদ ও ব্যাখ্যাই দিন না কেন, উহা যদি আমার মতো আমি-ওয়ালাদের কাছে পছন্দ ও যুক্তিসঙ্গত নাও হয় তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ, যত বড় বিদ্যার কচকচানিই আমাদের থাক না কেন, ওলিয়ে কামেলের সামনে আমাদের কোনো মূল্য আছে বললেও অতীব লজ্জার কথা।

আমাদের মূল্য আমরা এত বেশি দিয়ে ফেলি যার দরুণ ইসলাম ধর্মের এমন অবস্থা। আমরা জীবনে বোধ হয় একটি মুসলমানও বানাতে পারি নি, বরং মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি আর ফতোয়া মারতে পারি, তা এই অধম লেখকের লিখা দেখলেও বোঝা যায়। কত বড় বাক্কা পন্ডিত, এই অধম লেখকের লিখা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন। কিন্তু আসল পদার্থ তথা কামালিয়াতের ‘ক’-ও অর্জন করতে পারি নি। কামালিয়াত অর্জন না করে কলম হাতে নিলে কোনো অধিকারে? যদি আল্লাহ পাক প্রশ্ন করেন তবে কোনো উত্তরই দিতে পারবো না, বরং চোখের জলে ক্ষমা চাইতে হবে এবং ক্ষমা পাব কি না তা-ও জানি না। কারণ, আল্লাহকে পাবার পথে বিদ্যা হল সবচাইতে বড় পর্দা – ইহা অধম লেখকের কথা নয়, ইহা আহমদে মুখতারের (আ.) কথা।

অধম লেখকের কলমের শক্তি কতটুকু, পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারবেন এবং এই লিখনীর মায়াজালে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছি যে, নিজের ষাঁড়ের মতো স্বকীয়তা হতে মুক্তি পাই কি না জানি না, যদি কোনো ওলিয়ে কামেলের একান্ত দয়া হয় এবং নেক নজর থাকে এবং পদসেবা করতে পারি, তবে হয়তো ওলিয়ে কামেলের নুরি বীর্যের যে ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে উহা হতে ওলির ইচ্ছায় পেতে পারি। ওলিয়ে কামেলের নুরি বীর্যের যে ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে উহাকেই বলা হয় কাওসার।

এই কাওসার শব্দটি সমগ্র কোরান পাকে মাত্র একটিবার উচ্চারিত হয়েছে। কাওসার শব্দটি সাংঘাতিক গুপ্তরহস্য। ইহার প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করা শরিয়তে অশোভনীয়। ইহা নুরি বীর্যের একটি প্রবহমান ধারা। প্রতিটি বীজের মধ্যে প্রতিটি গাছের স্বভাব-চরিত্র লুকিয়ে থাকে। নিমগাছের ছোট বীজটাতে নিমগাছের গুণাবলি সুপ্ত অবস্থায় আছে। আমগাছের বীজের মধ্যে আমগাছের গুণাবলি ঘুমিয়ে আছে। আমের ছোট বীজটির মধ্যেই বিরাট আমগাছটির সব কয়টি গুণাবলি লুকিয়ে আছে। যখন এই বীজটি চারাগাছ হতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং অবশেষে একটি বিরাট গাছে পরিণত হয় তখন বোঝা যায় যে, এই বিরাট গাছের সবগুলো গুণই ঐ ছোট বীজটির মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভাবতেও অবাক লাগে যে, এত বড় গাছটার সমস্ত গুণাবলি কেমন করে এতটুকু বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে – যে গাছের কাঠ দিয়ে নানা রকম জিনিসপত্র তৈরি হয় – খাট, পালং, চেয়ার, টেবিল, আলমারি ইত্যাদি – এই ফার্নিচারের মূলেও সেই ছোট বীজটি। গাছের ফল দিয়ে নানা রকম উপাদেয় খাদ্য তৈরি হয় – আচার, আমট, মোরব্বা ইত্যাদি – এই উপাদেয় খাদ্যের মূলেও ঐ একই বীজ – আবার ইহার শিকড় ও পাতায় তৈরি হয় রোগমুক্তির বিভিন্ন ঔষধ – মূলে ঐ একই ছোট বীজ। একবার একটু ভেবে দেখুন তো, একটি ছোট বীজের ক্রমবিকাশের ধারার বিভিন্ন রূপগুলো কত বিচিত্র এবং বিস্ময়কর!

সামান্য একটি বীজ হতে যেমন বিরাট একটি গাছের জন্ম, তেমনি এক ফোঁটা বীর্যের মধ্যে নিহিত কোটি কোটি অতি ক্ষুদ্র বীর্যকীট যাহা চোখে ধরা যায় না, সেই একটি বীর্যকীট হতে একটি বিরাট মানুষের জন্ম। এই বিরাট মানুষটির দেহটি প্রথমে এতই ছোট ছিল যে, উহা খালি চোখে দেখা যায় না । দেখতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মধ্যে চোখ রাখলেই বোঝা যায় এর আয়তন কতটুকু। সাধারণ বীর্য তথা শুক্রের প্রবহমান ধারাকে কাওসার বলা হয় নি। নুরময় বীর্য তথা শুক্রের প্রবহমান ধারাকেই বলা হয়েছে কাওসার। কী সুন্দর রূপকতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে সাত বেহেস্তের যাবতীয় নালাগুলো বলতে একটি নুরময় মানবদেহ এবং দেহের ভেতর নুরি বীর্য চলাচলের বিভিন্ন পথগুলোকে বোঝানো হয়েছে। একটি জ্যোতির্ময় দেহই যে বেহেস্ত এবং একটি নয় সব কয়টি বেহেস্ত তথা সাতটি বেহেস্তের পূর্ণ অবস্থান, উহাকেই রূপক ভাষায় কাওসার বলা হয়েছে।

এই রূপকতার মধ্যে সত্য উপলব্ধি করতে যেন ভুল না করি তার জন্য কী সুন্দর করে পৃথিবীর মাটির সুগন্ধি আছে এই বেহেস্তের কাওসারে। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে, বেহেস্তের কাওসারের মধ্যে আবার পৃথিবীর যে মাটি তার গন্ধ কেন এবং সেই গন্ধ আবার সাধারণ গন্ধ নয় সুগন্ধিযুক্ত গন্ধ? রূপক ভাষায় সত্যটিকে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে এই বলে যে, সেই কাওসারের পানির রংটা কিন্তু পানির মতো নয় সাদা দুধের চেয়েও সাদা এবং হরিণের নাভি অপেক্ষা সুগন্ধী।

আমরা জানি সাধারণ বীর্যের রং সাদা এবং গন্ধযুক্ত। তাই এখানে আমাদের মতো সাধারণ বীর্যের কথা বলা হচ্ছে না – বলা হচ্ছে অতি অল্পসংখ্যক মহাপুরুষের তথা ফানাফিল্লাহর পর্যায়ের ওলিদের বীর্যের কথা কারণ, তারা আমাদের মতো সাধারণত্ব ডিঙিয়ে গেছেন তাই তাদের বীর্যের রূপ দুধের চেয়েও সাদা। এই দুধের চেয়েও সাদা এবং মৃগনাভির চেয়েও সুগন্ধী বলতে আর একটি রূপকতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ বীর্য এটা নয়। কারণ, এই বীর্যের ধারার মধ্যে মহাপুরুষ জন্ম নেয় আমাদের মতো নিটিক-ফিটিক জন্মাবে না। আরে ভাই, দুনিয়ার জিন্দেগিতেও আমরা দেখতে পাই, সাধারণত প্রতিভাবানের ঘরেই প্রতিভাবান জন্মায়।

যেমন গাছ তেমন তার ফল – এটা কাওসারের মতো উঁচু পর্যায়ের দর্শন নির্ণায়ক না হোক, কিন্তু আমাদের সাধারণ জীবনেও অনেকটা বাস্তব সত্য। কিন্তু দুঃখ হলো কি, চরম সত্য কথা কোরান পাকের যেখানেই প্রকাশ করেছে সেখানেই একঝুড়ি রূপকের চিকমিক করা কাগজে মুড়ে দিয়েছেন – তাই আসল সত্যটি সহজে ধরাই যায় না। তাই প্রায় সব তফসিরকারেরাই বাধ্য হয়ে অনেকটা পাগলের মতো আবোল-তাবোল যা-ইচ্ছা-তাই লিখে দায় সারেন। অনেকটা আদম-হাওয়ার গন্ধম খাবার রূপকের মতো। প্রায় সবাই আবোল-তাবোল কথার পাহাড় তৈরি করেছেন কিন্তু আসলে উহা হলো যৌনমিলন। কারণ, গম দেখতে অনেকটা নারী জাতির লজ্জাস্থানের মতো। অসম্ভবপ্রকার শালীনতার আশ্রয় গ্রহণ করতে গিয়ে রূপকের সাহায্য নেওয়া হয়েছে আর তারই দরুণ অনেকেই এর আসল অর্থটা বুঝে উঠতে পারেন না।

তাই নুরি বীর্যের প্রবহমান ধারার একটি চিরস্থায়ী অমরত্বের বৈশিষ্ট্য আতা করলেন তথা দান করলেন কে? ‘আমি’- আল্লাহ নয়, ‘আমরা’-রূপী আল্লাহ। একবচনে দান করেন নি দান করেছেন আল্লাহ পাক বহুবচনে। যাঁরা আল্লাহর দাস তাঁদেরকে নিয়ে তিনি ‘আমরা’। একটি মোমবাতির আলো দিয়ে হাজার বাতি আলোকিত করা যায়, তাতে প্ৰথম মোমবাতিটির আলো এতটুকু কমবেও না, বাড়বেও না। হাজার বাতির আলোর নাম ‘আমরা’ আলো – কিন্তু বহুবচন ব্যবহার হলেও আলো আসলে এক এবং অদ্বিতীয়। হাজারের মধ্যেও তিনি, অগণিতের মধ্যেও তিনি, আবার একের মধ্যেও তিনি – কী অপূর্ব বিজ্ঞানময় সুন্দরম সত্যম, সেকেন্ড টু নান।

এত বড় দান, যা সমস্ত কোরান পাকের সাতাত্তর হাজার নয়শত তেতাল্লিশটি শব্দের মধ্যে মাত্র একটি শব্দ – সেই আকাঙ্ক্ষিত শব্দটির নাম ‘কাওসার’ যাহা আতা করলেন অবশ্যই শব্দটি যোগ করে, সুলতানে আম্বিয়া (আ.)-কে আরবি ভাষার কোরান-এ এই বলে – ইন্না আতোয়াইনা কাল্ কাওসার – নিশ্চয়ই আমরা আতা করলাম আপনাকে কাওসার। এত বড় অমূল্য সম্পদ আপনি পেয়েছেন সুতরাং সালাত করুন আপনার রবের জন্য এখানেও আরবি কোরান-এর ভাষার সৌন্দর্য অপূর্ব বিজ্ঞানময় কারণ, এখানে সালাত কায়েম করতে বলেন নি। কারণ, সুলতানে আম্বিয়া (আ.) সালাত কায়েমের বহু ঊর্ধ্বে, তাই বলা হচ্ছে ফাসাললে লে রাববেকা এবং কোরবানি করুন তথা ওয়ানহার।

একমাত্র উট ছাড়া অন্য কোনো পশুকেই এই কোরবানি করার মধ্যে সম্পূর্ণ রূপকভাবে গ্রহণ করা হয় নি। কেন? উটকেই এখানে কোরবানি করার প্রতীকরূপে কেন বলা হলো? এ আবার আরেক রহস্য। উটকে দাঁড়ানো অবস্থায় প্রথমে বর্শা ফলক ছুঁড়ে মারতে হয় বুকে এবং কণ্ঠনালীতে। দাঁড়ানো অবস্থায় উটের বুক ও গলা দিয়ে রক্ত হু হু করে বেরিয়ে যেতে থাকে। ওহুদের যুদ্ধে সুলতানে আম্বিয়ার (আ.) পবিত্র রক্ত ঝরেছে, অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিলেন, কিন্তু শাহাদাৎ বরণ করেন নি। ” হোসায়েন মিননি, ওয়া আনা মিনাল হোসায়েন ” : সুলতানে আম্বিয়ার (আ.) কী বিস্ময়কর ঘোষণা – কী বিস্ময়কর মর্যাদার সর্বোচ্চশৃঙ্গ! নিরপেক্ষ দৃষ্টির নিরপেক্ষ দর্শনের পাল্লায় মাওলা আলির চেয়েও উচ্চ মর্যাদার পূর্ণ ইঙ্গিত সেই দানবীয় উচ্ছ্বাসের প্রেতনৃত্য নুরি বীর্যের পবিত্রতম পঞ্চধারার উপর যখন ইট-পাথরের তৈরি মসজিদের মিম্বরে অভাবনীয়, অচিন্তনীয় অভিসম্পাত বর্ষণ করা হতো প্রতি জুম্মার নামাজের খোতবায় ভাবতেও শরীর ঘৃণায়, লজ্জায় রি রি করে ওঠে।

সেই সময়ের সংগ্রহ করা এই সেই মূল্যবান হাদিসটি। যাদের মুখে মুসলমান শুনবে লক্ষ হাদিস তাদের মুখে শব্দ নেই কেন? যারা হাদিস সংগ্রহ করেছেন তারাও প্রাণের ভয়ে মাওলা আলির বর্ণিত হাদিস খুব বুঝে শুনেই গ্রহণ করতেন হাদিস না হলে। কারণ, তাতে দেহের মধ্যে মাথাটি নাও থাকতে পারে।

হাল্কা মুল্যের কোনো প্রয়োগপদ্ধতির সুলতানে আম্বিয়ার (আ.) সাহাবাদের আমরা একই তাজিমের দৃষ্টিতে দেখি। ছোট-বড় মর্যাদা থাকলেও আমরা সবাইকে অতীব শ্রদ্ধার সহিত তাদের নাম নেই। আল্লাহ পাক নবিদের মধ্যে পার্থক্য করতে যেমন বারণ করে দিয়েছেন আবার উঁচু-নিচুও করে রেখেছেন তিনি নিজেই। আল্লাহ পাক আরবি কোরান-এ দিবালোকের মতো স্পষ্ট ভাষায় সকল নবির চেয়ে হজরত মোহাম্মদ (আ.)-কে যে সর্বোচ্চ আসনে স্থান দিয়েছেন উহা প্রায় তফসিরকারকদের আজ পর্যন্ত নজরেই পড়ে নি। দলিল-প্রমাণের দ্বারা প্রমাণ না করে অনুবাদকারীরা গায়ের জোরে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন। পাঠক এবং অনুবাদকারী শ্রদ্ধেয় ভাইদেরকে অনুরোধ করি সূরা আলে ইমরানের একাশি নম্বর আয়াতটি মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে। এই একাশি নম্বর আয়াতই হজরত মোহাম্মদ (আ.) যে সর্বশ্রেষ্ঠ নবি উহার জ্বলন্ত প্রমাণ। আরবি কোরান-এর আর একটিও আয়াত নেই সুলতানে আম্বিয়ার (আ.) শ্রেষ্ঠত্বের এত সুন্দর অকাট্য দলিলরূপে বিবেচিত হতে পারে।

অধম লেখকের সবচাইতে বড় দোষ হলো যে, সে সাংঘাতিকভাবে নিরপেক্ষ। ধর্মের সাইনবোর্ডে সে বিশ্বাসী নয়। কারণ, সাইনবোর্ড মনে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু সত্যের দেশে নিয়ে যেতে পারে না। সে কারো দিকে তাকিয়ে কিছু লিখতে জানে না – এতে পাঠক বেজার অথবা খুশি যাই হোক তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তবে সংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীতে হজরত ইসা (আ.) তথা জেসাস ক্রাইস্ট তথা যিশু খ্রিস্টের উম্মত সবচাইতে বেশি। উম্মত তথা অনুসারী কোনো নবির সবচাইতে বেশি বলে প্রশ্ন করলে হজরত ইসার (আ.) নামই হবে প্রথম এবং যদি বেশি উম্মত যার তিনিই শ্রেষ্ঠ এই মানদন্ডে বিচার করা হয় তবে হজরত ইসাকে (আ.) সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসন দিতেই হবে। কারণ সত্য অপ্রিয় হলেও সত্য।

আল্লাহ পাক যেমন নবিদের মর্যাদার উঁচু-নিচু নিজে করে নিজেই আমাদেরকে ছোট-বড় করতে বারণ করে দিয়েছেন, ঠিক সে রকম সরদারে হাশেমি, ইমামে কেবলাতাইন (আ.)-ও সাহাবাদের মধ্যে মর্যাদার উঁচু-নিচু করে নিজেই আবার তা বারণ করে দিয়েছেন। কারণ, ইলেকট্রিসিটি তথা বিদ্যুৎ মূলত এক, অখন্ড কিন্তু বাল্বগুলো বিভিন্ন প্রকার এবং অখন্ড একক বিদ্যুতের ধারণ ক্ষমতার প্রকারভেদ থাকতে পারে এবং উঁচু-নিচু মর্যাদায় আলো ছড়াতে পারে, কিন্তু বিদ্যুৎ এক এবং ইহার ভাগ করা যায় না, তাই ইহা আহাদরূপে বিরাজমান। নবিরাও আহাদরূপে বিরাজমান, তাই ‘নুফারেকু’ তথা পৃথক করা যায় না। তাই যে যার নবির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। তার ব্যক্তিস্বাধীনতা ও দর্শনকে শ্রদ্ধাই জানাবো। কারণ, মূলত নবিরা সবাই এক। সিরাজুম মুনিরার (আ.) মর্যাদার হাদিসগুলো পড়লে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায় যে, ইমাম হোসায়েনকেই শ্রেষ্ঠত্বের তাঁজ মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন, তারপর মাওলা আলিকে, তারপর মা ফাতেমাকে এবং তারপর ইমাম হাসানকে এবং তারপর অন্যান্য সাহাবাদেরকে। (অবশ্য ইহা অধম লেখকের নিজস্ব মত এবং আমার মত ভুলও হতে পারে।)

এঁদের মর্যাদার সামনে হজরত আবুবকর সিদ্দিক, হজরত ওমর ফারুক এবং হজরত ওসমান ধারে-কাছেও ভিড়তে পারবেন না। কারণ, পাক পাঞ্চাতন কাওসারের দাতা, আর তাঁরা হলেন গ্রহিতা। বিজ্ঞজনের জন্য এই একটি বাক্যই বুঝবার জন্য যথেষ্ট। ইহা অপ্রিয় হলেও সত্য কথা। কারণ, ইহা অধম লেখকের কথা নয় স্বয়ং সরকারে দো আলমের (আ.) কথা। হোসায়েন মিননি ওয়া আনা মিনাল হোসায়েন – এই একটিমাত্র হাদিসই যথেষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণের জন্য, যদিও আরও অনেক মর্যাদার হাদিস ইমাম হোসায়েনের উপর আছে। হাদিসটির বাংলা অনুবাদ হলো ‘আমা হতে (হজরত মোহাম্মদ হতে) হোসায়েন এবং আমি (হজরত মোহাম্মদ) হোসায়েন হতে।’ ‘আমা হতে হোসায়েন’ ইহা অতি সহজেই বোঝা যায় এবং ইহা স্বাভাবিক, কিন্তু ‘হোসায়েন হতে আমি’ ইহা খুবই সাংঘাতিক কথা এবং ইহা বোঝাতে গেলে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরায় এবং ইহা খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়। কারণ, হজরত মোহাম্মদ (আ.) কেমন করে হোসায়েন হতে, এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে কি না জানি না, তবে অধম লেখক ইহার রহস্য বহু চেষ্টা করে আজও পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারি নি কেমন যেন সব গুপ্তরহস্যের ধূম্রজালে ছেয়ে আছে।

‘ওয়ানহার’-এর মতো স্বয়ং হজরত মোহাম্মদ (আ.) কারবালার মাঠে হোসায়েন নামক পবিত্র নামের উপাধি ধারণ করে, নাভিমূল হতে মাথা পর্যন্ত মোহাম্মদি সুরত নিয়ে, মোহাম্মদের তরবারি হাতে নিয়ে, মোহাম্মদি পাগড়ি মাথায় ধারণ করে, অসত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে আলি আকবর, আলি আসগরসহ প্রায় সবাই বুক আর কণ্ঠে তরবারির আঘাতে পূতপবিত্র রক্ত মোবারক কারবালার উষ্ণ বালিতে ঝরিয়ে বরণ করলেন শাহাদাৎ। আনা মিনাল হোসায়েন . ‘আমি হোসায়েন হতে’ তবে কি কারবালার মাঠে ইমাম হোসায়েন শহিদ হন নি? তবে কি গণনায় দুইটি পবিত্র দেহে একই একমাত্র কাওসার? তবে কি কাওসারের মতো সর্বশ্রেষ্ঠ দানের প্রতিদান এই ফাসালে লে রাব্বেকা ওয়াহার তথা যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ দান কাওসার (সেহেতু) সুতরাং আপনার রবের জন্য সালাত করুন এবং কোরবানি করুন? এই কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধরত অবস্থায় যে বা যারা আপনার পাশ হতে কেটে পড়ে সে বা তারা কাওসার তথা নুরি বীর্যের প্রবহমান ধারার মহানিয়ামত হতে বঞ্চিত, অর্থাৎ আপনাকে যারা এড়িয়ে যায় তারা নিঃসন্তান।

এই ‘নিঃসন্তান’, এই আবতার তথা লেজকাটা শব্দটি আর একটি সাংঘাতিক গুপ্তরহস্যপূর্ণ কথা। কারণ, যারা হজরত মোহাম্মদ (আ.)-এর বিরুদ্ধে ছিল এবং আছে তাদের কি ছেলে-মেয়ে নেই? হ্যাঁ, সত্যিই তাদের কোনো সন্তান নেই। তাদের একেকজনের ডজন-ডজন ছেলে-মেয়ে থাকতে পারে, তবু তাদের কোনো সন্তান নেই। কেন? কারণ, সেইসব সন্তানদের মধ্যে নুরি বীর্যের প্রবহমান ধারা নেই – এই নুরি বীর্যের ধারা হতে তারা বঞ্চিত। সুতরাং তারা আকারে যদিও মানুষের মতো, কিন্তু প্রকৃতই তারা পশু। তাদের ভাগ্যে পশুজন্ম ছাড়া আর কী থাকতে পারে? যদিও মানুষের মতো হুবহু দেখতে, তাই মানুষ বলে ভ্রম হয়। যারা মানুষ জন্ম দেয় নি, দিয়েছে মানুষরূপী পশু, তারা কি নিঃসন্তান নয়? তারা কি অপুত্রক নয়? এই পৃথিবীতে যত প্রকার আল্লাহ্ দান আছে তার মধ্যে কি সৎ পুত্র তথা নুরি বীর্যের পুত্র লাভ করা সর্বশ্রেষ্ঠ দান না? সুতরাং নিশ্চয়ই যে আপনাকে এড়িয়ে যায় সে নিঃসন্তান।

এই ‘আপনি’ বলে ডাকছেন যে হজরত মোহাম্মদ (আ.)-কে, তিনি কে? তিনিই নুরে মোহম্মদি রূপে বিকশিত হয়ে ছুটে চলেছেন নুরি বীর্য দান করতে। কাকে? যে বা যিনি আপন আমিত্ব তথা আপন স্বকীয়তা পরিত্যাগ করে নুরে মোহাম্মদিতে ফানা তথা বিলীন হতে পেরেছেন তাকে এই মহানুরি বীর্য দান করতে। তাই প্রতিটি ওলিয়ে কামেলের মধ্যে এই নুরি বীর্য ধারণ হয়ে আছে নুরে মোহাম্মদের একমাত্র কাওসার হতে। মোহাম্মদ নামক নুরের মোমবাতি হতে যত হাজার নুরের মোমবাতির আলো ছড়িয়ে পড়ুক না কেন উহা এককের মধ্যেই এক নুর । আল ইমরানের একাশি নম্বর আয়াতের ভাষায় নুরি মোহম্মদি মোমবাতি হতে যে হাজার নুরি বাতি একই আলোয় আলোময় হয়ে আছে তাদের আলোর সামনেও পূর্ববর্তী নবিদের মর্যাদা একই রকম। কারণ ‘হোসায়েন যেমন মোহাম্মদ হতে তেমনি মোহাম্মদও হোসায়েন হতে’-এর গুপ্তরহস্য যিনি উপলব্ধি করেছেন তিনি আর চেঁচামেচি করবেন না।

মাওলা আলি এবং ইমাম হোসায়েনের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য নির্ণয় করা বোকামি এবং বেয়াদবি। কারণ নুরি সাগরের সবাই এক একটি নুরি মাছ। অবশ্য এই নুরি মাছের আয়তনে বড়-ছোট থাকতে পারে এবং কে বড় এবং কে ছোট ইহার গবেষণা না করে নিজে কেমন করে নুরি বীর্যের অধিকারী হয়ে নুরি মাছে পরিণত হতে পারবো সেই ফিকিরে থাকাই আমাদের অবশ্য এবং একমাত্র কর্তব্য। তবে যদি সাহেবে মেরাজ (আ.) মর্যাদার পার্থক্য করে যান, উহার কেবলমাত্র বর্ণনা দিতে পারি, কিন্তু মন্তব্য অশোভনীয়। আমিত্বের আঁধারে থেকে এই বর্ণনা করতে গিয়েও ভুল এবং বেয়াদবির সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে। তবে খুব সতর্ক এবং নিরপেক্ষ হয়েই করতে হচ্ছে। আমরা হজরত সাহেবে মেরাজের (আ.) হাদিস হতে যা পেয়েছি কেবল উহারই বর্ণনা করছি। যদিও প্রায় লোকেই জানেন যে, হুজুর পাকের (আ.) সাহাবাদের মধ্যে সবচাইতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হলেন মাওলা আলি।

কয়টি হাদিসের গভীরতা দেখলেই উহা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন হুজুর পাক (আ.) বলছেন, ‘আমি যার মওলা, কোনো সন্দেহ নেই আলিও তার মওলা’; আবার বলছেন, “আমি জ্ঞানের শহর, আলি তার দরজা’; এবং আবার বলছেন, ‘আলির মূল্য আমার কাছে ততটুকু, দেহের মধ্যে জীবনের মুল্য যতটুকু’; আবার বলছেন, ‘যে আলিকে সাহায্য করে সে আমাকে সাহায্য করে এবং যে আলি হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়;’ আবার বলছেন, ‘আলি আমার কাছে সে রকম, যে রকম মুসার কাছে হারুন, যদিও আমার পর নবি নেই’; আবার বলছেন, ‘যে আলির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে, সে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে এবং যে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে, সে আল্লাহ্ বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে।’

  • (কালান্দার ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা- ঈমান আল সুরেশ্বরী)
  • নিবেদক: আর এফ রাসেল আহমেদ ওয়ার্সী আল জাহাঙ্গীর
আরো পড়ুনঃ