সত্তা ও স্মৃতির স্রোত
সময়টা কি কেবলই নদী? নাকি নিজেই তার স্রোত? এই যে আমি, এই মুহূর্তে যা ভাবছি, এই ‘আমি’-ই কি সেই ‘আমি’ যে গত বছর এক বিকেলে হাসছিল? প্রতি মুহূর্তে কোষেরা যেমন তাদের গঠন বদলাচ্ছে, ঠিক তেমনই স্মৃতি আর সংকল্পের পলিও কি জমা হচ্ছে না মনের গভীরে?
আমি কাকে বলি ‘আমি’? আমার এই নাম, এই পরিচয়— এগুলো কি স্থায়ী? গতকালের হাসি, কালকের দুঃখ, দু’দিন আগের স্বপ্ন, সবকিছুর সমষ্টিই কি আজকের আমি? কিন্তু যেই দুঃখ আজ ভোলা গেল, সেই দুঃখ কি আর আমার অংশ রইলো? নাকি তা নদীর বাঁকের মতো কেবলই ফেলে আসা জল?
মনের ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে কত সম্পর্ক, কত আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষারা কি সত্যিই আমার তৈরি? নাকি পারিপার্শ্বিকতার জল-হাওয়ায় বীজ হয়ে গেঁথে গেছে? যে স্বপ্ন একসময় আমাকে ঘুমোতে দেয়নি, সেই স্বপ্ন এখন বিস্মৃত। যদি স্বপ্নই না থাকে, তবে সেই আমি কি রইলো?
আমরা মুহূর্তের সন্তুষ্টির জন্য ছুটে চলি। আজকের প্রয়োজন, আজকের তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা মেটে, কিন্তু আগামীকাল আবার নতুন তৃষ্ণা নিয়ে আসে। যেন একটি বুদ্বুদ: তৈরি হলো, সুন্দর দেখালো, গলা পর্যন্ত আনন্দ দিলো— অতঃপর ফেটে গেল। আমরা বুদ্বুদটিকে ধরি, তার রঙে মুগ্ধ হই, কিন্তু তার আয়ু যে এক পলকের, তা ভুলেই যাই।
এই ক্ষণিকের ‘মজা’ বা ‘তৃপ্তি’ হচ্ছে অস্থির জলের উপরিভাগ। সেখানে রঙ আছে, শব্দ আছে, কিন্তু ভিত্তি নেই। একটু হাওয়া দিলেই সব এলোমেলো। বুদ্ধিমান সে, যে জলের এই চঞ্চলতা দেখেও শান্ত থাকে, নদীর গভীরে স্রোতের শাশ্বত পথটিকে খোঁজে।
পারমার্থিক শান্তি ঠিক সেই নদীর গভীরতম নীরবতার মতো। সেখানে কোলাহল নেই, তাড়াহুড়ো নেই, অস্থিরতা নেই। সময়ের স্রোত সেখানে আছে, কিন্তু সেই স্রোত কেবল অস্তিত্বকেই বহন করে নিয়ে চলে, কোনো অস্থায়ী পরিচয়কে নয়। সেই শাশ্বত সত্তার স্বাদ একবার পেলে, ক্ষণিকের বুদ্বুদে আর মন মজবে না।
– ফরহাদ ইবনে রেহান