পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বীরসিংহ

পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বীরসিংহ

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার ঘাটাল ব্লকের বিখ্যাত গ্রাম বীরসিংহ। বৃটিশ ভারতে হুগলি জেলার অধীনে ছিল। হাওড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বাসে বীরসিংহ মোড়ে নেমে অটোরিক্সায় বীরসিংহ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্মৃতি বিজড়িত বসতবাড়ি।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আদি বসতবাড়ির অস্তিত্ব আজ আর নেই। তাঁর জন্মভিটার স্থানে পাঁচটি স্থাপত্য অতীতের স্মৃতি রক্ষার্থে ইট-সিমেন্টের মারফত নির্মাণ করা হয়েছে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির ও সংগ্ৰহশালা।
১৯৩৭ সালে বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতির প্রচেষ্টায় জন্মস্থানে একটি স্মৃতি মন্দির রেপ্লিকা বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়, ১৯৪০ সালে সমাপ্ত হয়।

১৯৪০ সালের ১৭ মার্চ শিক্ষাবিদ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এই বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের উদ্বোধন করেন। বিদ্যাসাগর ঠিক যে স্থানে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেই জায়গা চিহ্নিত করে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর একটি ছোট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্মৃতিমন্দিরের পাশে একটি পাঠাগার ও সংগ্রহশালা তৈরি করা হয়েছে। এই স্মৃতিমন্দির প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে।

সংগ্রহশালায় ছোট ছোট পুতুলের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের জীবনপ্রবাহ নির্ভিক ভাবে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে।
বিদ্যাসাগরের দৈনন্দিন ব্যবহ্নিত জিনিসপত্র, পোশাক, চশমা, বর্ণপরিচয়ের মূল কপি,ধাতু নির্মিত পেপার, স্টিল ট্রাঙ্ক,ওয়েট, বহু পুস্তক, পান্ডুলিপি, মানিব্যাগ, বাঁধানো দাঁত, ভিজিটিং কার্ড, প্রেসের তাম্রফলক ব্যতীত তাঁর বংশ তালিকা প্রভৃতি যত্ন সহকারে সংরক্ষিত আছে।

স্মৃতিমন্দিরের অদূরে স্মৃতি বহন করে আছে বিদ্যাসাগরের শিক্ষক কালিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা। এই বীরসিংহ গ্ৰামে ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন (১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ) মঙ্গলবার দ্বিপ্রহরে ঈশ্বরচন্দ্র আর্বিভূত হন। হুগলি জেলার আরামবাগ ব্লকের মলয়পুর-২ গ্ৰাম পঞ্চায়েতের বনমালীপুর গ্ৰামে প্রপিতামহ ভুবনেশ্বর বন্দোপাধ্যায় বসবাস করতেন।

পিতামহ রামজয় বন্দোপাধ্যায়ের দুই পুত্র-ঠাকুরদাস ও কালিদাস। চার কন্যা- মঙ্গলা, কমলা, গোবিন্দমণি, অন্নপূর্ণা। পিতামহ রামজয় একদিন স্বপ্ন দেখলেন, “তার বংশে এক উত্তম সন্তান জন্ম নেবেন, তিনি অদ্বিতীয় পন্ডিত হবেন, সবার দুঃখ মোচন করবেন এবং বংশের কীর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।” এই সন্তানের নাম রাখলেন ঈশ্বরচন্দ্র। পিতা ঠাকুরদাস ও মাতা ভগবতী দেবীর সাত পুত্র-ঈশ্বরচন্দ্র, দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র, হরচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র, শিবচন্দ্র। তিন কন্যা-মনোমোহিনী, দিগম্বরী, মন্দাকিনী।

১৮২৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের পাঠচর্চা শুরু হয় কালীকান্ত চট্রোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। ১৮২৯ সালের ১ জুন পিতা ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতা পটলডাঙার সরকারি সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৮৩২ সালে তিনি সাহিত্য শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হন। ১৮৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অলঙ্কার শাস্ত্রের ক্লাসে প্রবেশ করেন। ১৮৩৬ সালে বেদান্ত শ্রেণীতে প্রবেশ করে বেদান্ত চর্চা করতেন। ১৮৩৭ সালে কলেজের মাসিক আট টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হন।

১৮৩৮ সালে স্মৃতি শ্রেণীতে প্রবেশ করলেন। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল ল’ কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ১৯৩৯ সালে ল’ কমিটির সমীপ হতে প্রশংসাপত্র পান, তাতেই তার নামের সঙ্গে “বিদ্যাসাগর” উপাধিটি ব্যবহ্নত হয়। ১৮৩৯ সালে তিনি ন্যায় শ্রেণীতে প্রবেশ করলেন।এর সঙ্গে জ্যোতিষ শ্রেণীতেও পড়েছিলেন। পরে ইংরেজি শিক্ষা করেন।

১৮৪১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ৫০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিত পদে যোগ দেন। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল একই বেতনে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারি সম্পাদকের ভার গ্ৰহণ করেন।সম্পাদক ছিলেন, রসময় দত্ত। ১৮৪৯ সালের ১ মার্চ ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে পাঁচ হাজার টাকা জামিনে চাকরিতে সংযুক্ত হন।

১৮৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ৯০ টাকা বেতনে সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপক হন। ১৮৫৫ সালের ১ মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ ব্যতীত মাসিক অতিরিক্ত দুইশো টাকা বেতনে পশ্চিমবঙ্গে সহকারি বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে আসীন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মনোনীত হন। ১৮৫৭ সালে হুগলি জেলায় সাতটি,বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৫৮ সালে হুগলি জেলায় তেরোটি, মেদিনীপুরে তিনটি,বর্ধমানে দশটি, নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

১৮৬১ সালে বিদ্যাসাগর কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি হন। ১৮৬৩ সালে সরকার প্রদত্ত ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউটের পরিদর্শক নিযুক্ত হন। ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট পুত্র নারায়ন চন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগরের শম্ভুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ হয়। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কাশিতে মাতা ভগবতী দেবীর মৃত্যু হয়। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের কল্যাণার্থে “হিন্দু ফ্যামিলি অ্যালুয়িটি ফান্ড” নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৮৭৫ সালের ৩১ মে বিদ্যাসাগর নিজের সমুদয় সম্পত্তির উইল প্রস্তুত করেন। ১৮৭৬ সালের ১২ এপ্রিল পিতা ঠাকুরদাস প্রয়াত হলেন। এই সময় কলকাতা বাদুড়বাগানে একটি বাড়ি ক্রয় করেন।এই বাড়ির ঠিকানা-২৫, বৃন্দাবন মল্লিক লেন, (বর্তমানে ৩৬, বিদ্যাসাগর স্ট্রিট)। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে এই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর সি. আই.ই উপাধিতে ভূষিত হন। ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণ তার বাদুড়বাগানের বাড়িতে আসেন। ১৮৮৩ সালে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় -এর ফেলো নির্বাচিত হন। ১৮৮৮ সালের ১৩ আগস্ট পত্নী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়।

১৮৯০ সালের ১৪ এপ্রিল বীরসিংহ গ্ৰামে মাতার স্মৃতিতে “ভগবতী বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন।যা আজও স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ( ১৩ শ্রাবণ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ) বিদ্যাসাগর মহাশয় রাত্রি দুইটা আঠারো মিনিটে লিভারের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার বাদুড়বাগানের বাসভবনে পরলোক গমন করেন। ৩০ জুলাই ১৮৯১ সালে সূর্যোদয়ের পূর্বে অন্ত্যোষ্টি সুসম্পন্ন হয়। কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশার্নে।
১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী “বিদ্যাসাগর চরিত” প্রকাশ করেন পুত্র নারায়ন চন্দ্র বিদ্যারত্ন।

উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থাবলি-বেতাল পঞ্চবিংশতি, বাঙালার ইতিহাস, শিশুশিক্ষা, বোধোদয়, ঋজুপাট, ব্যাকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা, বর্ণপরিচয়, বিধবা বিবাহ, কথামালা, সীতার বনবাস প্রভৃতি।

পত্নী- দিনময়ী দেবী (১৮২৬-১৩. ৮. ১৮৮৮), পুত্র- নারায়ণচন্দ্র (১৮৪৯, ৩০ কার্তিক ১২৫৬ বঙ্গাব্দ), মৃত্যু (১১. ৮. ১৮৭০, ২৭ শ্রাবণ ১২৭৭ বঙ্গাব্দ। নারায়ন ও ভবসুন্দরীর পুত্র-প্যারীমোহন, কন্যা-মৃণালিনী (পুত্র-সরোজ মুখোপাধ্যায় ), কুন্দমালা(পুত্র-প্রফুল্লকমল ঘোষাল, হাসি বন্দোপাধ্যায়, নীহার মুখোপাধ্যায়, রাইমণি ভট্রাচার্য)মতিবালা( পুত্র-ক্ষীতীশ প্রসাদ চট্রোপাধ্যায়।

কন্যা-(১) হেমলতা-(পুত্র- সুরেশ চন্দ্র, জ্যোতিষচন্দ্র। (২) কুমুদিনী–তিন পুত্র, চার কন্যা। (৩) বিনোদিনী – চার পুত্র, চার কন্যা। (৪) শরৎকুমারী- দুই পুত্র।

২০২০ সালে বীরসিংহে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুপ্রেরণায় বিদ্যাসাগরের ২০০-তম জন্ম দিবস উপলক্ষে মহাসমারোহে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বীরসিংহ গ্রাম থেকেই। বীরসিংহ গ্রাম রাজ্যের সেরা এক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেন, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। বীরসিংহ গ্রামে প্রতি বছর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিদ্যাসাগর মেলা অনুষ্ঠিত হয়।আয়োজক- বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি

লেখা: মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী।

আরো পড়ুনঃ