সে এসেছিল নীরবে-কোনো আভাস, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া।
তার হাতে কোনো চিঠি ছিল না, চোখে ছিল না পূর্বপরিচয়ের আভা, তবুও মনে হচ্ছিল—তাকে অনেক আগে থেকেই চেনা, যেন জন্মের আগ থেকেই তার অপেক্ষায় ছিলো পাঠকের ভেতর এক গোপন প্রকোষ্ঠে।
“কে তুমি?”—প্রশ্নটা ছিল না কৌতূহল থেকে, ছিল যেন এক আত্মীয় অভিবাদন।
সে হেসেছিল, কিন্তু সে হাসি কোনো ছেলেমানুষি নয়—তা ছিল এক দার্শনিক ব্যাখ্যার মতো, অথবা এক রহস্যভেদী মৃদু সূচনা।
“আমি জীবন্ত গ্রন্থ।”
এই বাক্য পাঠকের বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য কাঁপন তুলে দিয়েছিল।
বই? কিন্তু সে তো কাগজের হয়! বই তো পড়ার জন্য!
কিন্তু এই বই কি কেবল পড়ার জন্য এসেছিল? নাকি সে পাঠককে পড়তে এসেছিল?
সে গ্রন্থ, কিন্তু তার বর্ণ নেই; শব্দ আছে, কিন্তু লেখা নেই; পৃষ্ঠা আছে, কিন্তু তাতে খচিত অনুভব। তার পাতাগুলো নড়ে উঠত বাতাসে, যেন প্রতিটি শ্বাসে সে নিজেকে উন্মোচন করছে।
পাঠকের মন তখন দ্বিধার সীমারেখায়—চায় পাঠ করতে, আবার ভয় পায় এই পাঠে হারিয়ে যাওয়ার।
সে ভাবে—”এই বই পাঠ যদি গন্ধমের মতো হয়, তাহলে কি আমার পতন অনিবার্য?”
কিন্তু প্রতিনিয়ত ছায়ার মতো ঘোরে সেই আকর্ষণ।
‘জানতে চাই’—এই প্রবল তৃষ্ণা তাকে টেনে নিয়ে যায়।
জীবনের উদ্দেশ্য, মহাবিশ্বের রহস্য—এসবের পেছনে ছুটতে ছুটতে যে ক্লান্তি, সেই ক্লান্তি নিয়েই পাঠক স্পর্শ করে প্রথম পৃষ্ঠা।
এ শুরু একটি বোধের।
এ শুরু নিজেকে হারিয়ে দেওয়ার।
এ শুরু পাঠকের চোখ নয়, আত্মা দিয়ে পাঠ করার।
এই অধ্যায়ে সে জানে, বই শুধু শব্দের বাহক নয়—এ এক রক্তমাংসের ধ্বনি, এক ধোঁয়াটে কামনা, এক করুণার তরঙ্গ।
এ গ্রন্থ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে জানে না—কিন্তু জেনে নেয়, সে আর ফিরবে না।
প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম স্পর্শেই পাঠক বুঝে যায়—এ পাঠ কোনো নিয়মিত পাঠ নয়।
এ পৃষ্ঠা নিঃসাড় নয়, এ বই নীরব নয়।
তার গায়ে রক্তের তাপ, তার ভাঁজে নিশ্বাসের গন্ধ, তার ভাষা কেবল চোখ দিয়ে পড়া যায় না—পড়া লাগে আঙুল দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে, শরীর দিয়ে, চেতনা দিয়ে।
প্রতিটি বাক্য যেন একটি স্পর্শ, প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন দীর্ঘ অলিংগন।
এ পাঠ করতে গেলে নিজেকে খুলে দিতে হয়, যেমন শরীর খুলে দেয় প্রেমিকা তার প্রেমিকের কাছে।
এ পাঠে নেই সামাজিকতা, নেই বাধ্যবাধকতা—আছে কেবল এক অন্তর্জাগতিক আহ্বান—‘পড়ো, আমাকে পড়ো, তোমাকে উন্মোচন করো আমার ভিতরে।’
পাঠক আর শুধু চোখ দিয়ে পড়ে না, তার দৃষ্টি চলে যায় গভীরে—ভাষার নিচে, বর্ণের অন্তরালে, অনুভবের আশ্রয়ে।
সে পড়ে এক অনুভব, যেখানে নারীগ্রন্থের স্তব্ধতা নিজেই আওয়াজ হয়ে ওঠে।
কখনো সে একটি শব্দের ভিতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে,
কখনো একটি বাক্য তাকে এনে ফেলে স্মৃতির এমন এক সীমানায়,
যেখানে যৌবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ব্যথা, প্রথম কামনা একসাথে ডুকরে ওঠে।
এ পাঠ একধরনের সম্ভোগ, কিন্তু তা কেবল শরীরঘেঁষা নয়—
এ এক রসগ্রহণ, যা তৃষ্ণা বাড়ায়, কিন্তু তৃপ্তিও দেয়।
এ রস স্বাদে যেমন গভীর, তেমনি ত্যাগেও প্রশান্ত।
পাঠকের মনে হয়—‘আমি আর বই পড়ছি না, বই-ই আমাকে পড়ছে।
সে জানে কোথায় আমার ভয়, কোথায় আমার কামনা, কোথায় আমার অপূর্ণতা।’
এ অধ্যায়ে পাঠক আর পাঠকের বাইরে থাকে না—
সে গলে যায় বইয়ের প্রতিটি ছন্দে, প্রতিটি নিশ্বাসে,
সে হয়ে ওঠে গ্রন্থের এক ভাঁজ—একটি অনুচ্ছেদ—একটি গভীর প্রতিধ্বনি।
“সম্ভোগ থেকে সমাধি”
সম্ভোগ—যেখানে শরীর প্রথমে স্পর্শ করে শব্দকে।
প্রথমে তা এক উত্তেজনা, এরপর তা এক আকর্ষণ, তারপর এক জ্বালা।
কিন্তু পাঠ যতই গভীর হয়, ততই সে বুঝতে পারে—এই জ্বালা দেহের নয়, আত্মার।
এ এক উল্টো যাত্রা—যেখানে উপভোগ নয়, উন্মোচন মূল বিষয়।
প্রথমে সে বইয়ের প্রতিটি বাক্যে কামনা খুঁজেছে,
আর এখন সে খুঁজছে নিরাময়।
প্রথমে বইয়ের ভাঁজে সে প্রেমিকা খুঁজেছে,
এখন খুঁজছে মুক্তি।
প্রথমে তার শরীর কাঁপত পাঠে,
এখন কাঁপে তার চিন্তা, তার বিশ্বাস, তার পরিচিতি।
সে দেখে, তার সমস্ত পাঠ আসলে এক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—
নিজের, তার কামনার, তার অহংকারের।
প্রতিটি শব্দ যেন তরবারি—
কেটে ফেলছে তার অহংকার, তার ভোগের আকাঙ্ক্ষা, তার মনের জড়তা।
সে অবাক হয়ে দেখে, বইটি কোনো নারীর শরীর নয়,
এ যেন তার নিজেরই আদি রূপ,
নিজের মধ্যেই এক মহাবিশ্ব, এক রহস্যের পাণ্ডুলিপি।
সম্ভোগ এখানে অন্তর্হিত, আর জেগে ওঠে ‘সমাধি’—
এক চুপচাপ আত্মতৃপ্তি, যেখানে শরীর আর চায় না, মন আর খুঁজে না,
শুধু চেতনা বসে থাকে—নিঃশব্দ, নিবিষ্ট, নিস্পন্দ।
এই যে সম্ভোগ থেকে সমাধির যাত্রা—
এ যেন এক আত্মিক মিলন, যেখানে দুটি অস্তিত্ব নয়,
থাকে কেবল একটাই সত্য, একটাই শুদ্ধ অনুভব—
বই ও পাঠক মিলেমিশে হয়ে যায় এক।
“নীরবতার জেগে ওঠা”
শব্দের পর, পাঠের পর, উত্তেজনার পর, প্রশান্তি আসে।
তবে সে প্রশান্তি শব্দহীন।
পাঠক জানে—সে আর কিছু পড়ছে না,
সে নিজেই হয়ে উঠেছে পঠিত।
পড়তে-পড়তে, ছুঁতে-ছুঁতে, অনুভব করতে-করতে
একসময় পাঠক আর গ্রন্থ আলাদা থাকে না।
তার চোখে কিছু পড়ে না, তার হাতে কিছু ধরা পড়ে না,
তার মুখে কোনো বাক্য উঠে না,
শুধু তার ভেতরে এক নীরব ধ্বনি বাজে।
সে বোঝে, এই নীরবতাই ছিল বইয়ের প্রকৃত ভাষা।
যে শব্দ তাকে উত্তেজিত করেছিল,
সেই শব্দই এখন তাকে শূন্য করে দিচ্ছে।
শূন্যতা, যা ভয়ের নয়, বরং মুক্তির।
শূন্যতা, যা খালি নয়, বরং ভরপুর।
এই যে নীরবতা—এটাই পরিণাম নয়,
এটাই নতুন শুরু।
এই নীরবতা একজন শিষ্যকে করে তোলে গুরু,
এক পাঠককে করে তোলে এক জীবন্ত গ্রন্থ।
এখানেই সে উপলব্ধি করে, বইটি আর তার বাইরে নয়—
বইটি তার ভেতরে, এবং সে নিজেই এখন পাঠযোগ্য।
“গ্রন্থের অন্তিম পৃষ্ঠা”
গ্রন্থের ভাঁজে-ভাঁজে ঘোরার পর, একদিন পাঠক এসে দাঁড়ায় সেই পাতায়—
যেখানে আর কিছু লেখা নেই।
শুধু সাদা কাগজ।
তবুও সে পড়ে। গভীরভাবে পড়ে।
কারণ, এ সাদা কাগজ আর ফাঁকা নয়।
এখানে লেখা আছে—
তোমার জীবনের সমস্ত প্রশ্ন।
এখানে ফুটে আছে তোমার সমস্ত কামনা,
তোমার সমস্ত আঘাত,
তোমার প্রত্যাখ্যান,
তোমার প্রথম ভালোবাসা,
তোমার শেষ নিঃশ্বাস।
এটাই গ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠা—যেখানে কোনো শব্দ নেই,
শুধু প্রতিধ্বনি।
যা শোনা যায় না কানে, বোঝা যায় হৃদয়ে।
পাঠক দেখে—সে কোনো নারীর শরীর পড়েনি,
সে পড়েছে এক মহাজীবনের ভাষা।
নারী নয়, সে পেয়েছে ‘আদি গ্রন্থ’,
যেখানে নারী রূপ নিয়েছে আদি শক্তিতে, আদি রহস্যে।
এ পাঠ তাকে শিখিয়েছে—
সম্ভোগে লুকানো থাকে সমাধি,
আবরণেই লুকানো থাকে মুক্তি,
আর প্রতিটি চাহিদার ভেতরেই আছে ত্যাগের বীজ।
এই পাঠের শেষে সে আর শুধু পাঠক নয়,
সে হয়ে উঠেছে নিজেই একটি পাণ্ডুলিপি—
যা লেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।