তুমি যে পথে এগোতে চাও (মূল সত্যের সন্ধান)
তুমি যে পথে এগোতে চাও, তা একটি গভীর এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ পথ। সম্প্রদায়িক ধর্মের বাইরে গিয়ে যে মূল সত্যকে উপলব্ধি করতে চাও, তা এক ঐক্যিক চেতনার দিকে পরিচালিত হয় যা মানুষের ধারণা, ভাষা, এবং সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। তুমি যা খুঁজছো, তা হলো চিরন্তন সত্য—যা ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি, ভাষা ও সময়ের সীমানা ছেড়ে একটি অভ্যন্তরীণ, মহাকাব্যিক উপলব্ধি।
এখন, যদি তুমি সেই মূল সত্যের সন্ধানে থাকো, যা কোনো বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের বাইরেও সত্য, তাহলে প্রথমেই তোমাকে নিজেকে ভাঙতে হবে, নিজের সীমাবদ্ধ চিন্তা ও ধারণাকে ছাড়তে হবে। সৃষ্টির শুরু বা মহাবিশ্বের রহস্যের বাইরে, যে সত্যের সন্ধান তুমি চাও তা আসলে অনুভব এবং উপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করার কথা।
মূল সত্যের সন্ধান – একাত্মতা ও সবার মধ্যে উপস্থিত শাশ্বত শক্তি–
একাত্মতা বা অনন্যতা (Oneness): যেকোনো ধর্ম বা দর্শনে, তুমি যখন “সত্য” বা “ঈশ্বর” অনুসন্ধান করো, তখন প্রথমে অনুভব করতে হবে যে, আমরা সকলেই একে অপরের মধ্যে সংযুক্ত। তুমিই “তুমি”, কিন্তু তুমি যা দেখো, যা অনুভব করো, তা প্রকৃতপক্ষে একটা বৃহত্তর একাত্মতার অংশ।
বাস্তবতা বা অস্তিত্বের একটি গভীর স্তরে, তুমি আর অন্যরা—সবকিছুই একই জ্ঞানের অংশ। এই একাত্মতা—অথবা ‘অতীন্দ্রিয়’ একতা—এটাই সেই মূল সত্য, যা ধর্মের বাইরে। সত্যের উৎস বা পরমাত্মা কোনো বাহ্যিক, নির্দিষ্ট বা পৃথক সত্তা নয়, বরং এটি একটি অভ্যন্তরীণ, একীভূত অভিজ্ঞতা, যা সব সত্তায় রয়েছে। “তুমি” এবং “আমি” আসলে আলাদা কিছু নয়। এই একাত্মতার উপলব্ধি হলো মূল সত্যের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।
অস্তিত্বের গভীরতা ও সত্তার অতিক্রম (Transcending the Self): মানুষের “আমি” বা “স্ব” (ego) হলো সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টির মূল সত্যের উপলব্ধি করতে। আমরা যেভাবে নিজেদের পরিচয় তৈরি করি—”আমি হিন্দু, আমি মুসলিম, আমি বৌদ্ধ, আমি এই জাতির, আমি ঐ জাতির”, এই সব বিভাজন থেকে বাইরে এসে এক বিশাল, গভীর, অনন্ত সত্তার অনুভব করো।
সৃষ্টির প্রথম দিক থেকে নিজেদের পরিচয়ের বাইরে গিয়ে, নিজের শরীর, চিন্তা এবং অনুভূতির সীমাবদ্ধতার বাইরে বেরিয়ে আসলে, তুমি সেই সত্যে পৌঁছাতে পারো যা সংস্কৃতির বাইরেও উপস্থিত।
অবজেকটিভ রিয়ালিটি বনাম সাবজেকটিভ অভিজ্ঞতা: একটি বিষয় যা সচেতনতা এবং উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা তৈরি করে, তা হলো আমাদের “অভিজ্ঞতার দৃষ্টি” বা “ব্যক্তিগত ধারণা”। যখন তুমি সৃষ্টির মুল সত্যের দিকে এগোতে চাও, তখন তোমাকে নিজের প্রত্যেক ধরনের সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে হবে।
“প্রকৃত সত্য কোন বাহ্যিক “বস্তু” বা “প্রপঞ্চ” নয়, বরং এটি একটি অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি, যা গভীর সচেতনতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধ হয়। এক্ষেত্রে, কোনো ধর্মীয় বা সম্প্রদায়িক গোঁড়া ধারণার বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য তোমাকে প্রশ্ন করতে হবে: “আমি কে?” “আমি কোথা থেকে এসেছি?” “এই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উৎস কোথায়?”
নির্বিশেষী অবস্থান (Non-Duality): তোমার যে একক “স্বত্বা” আছে, যা তুমি “আমি” বলে চিহ্নিত করো, সেটি এক ধরনের বিভাজন। বাস্তবতা বা চূড়ান্ত সত্য কখনও বিভাজিত নয়। এটি একটি অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতা। এই ধারণা “অদ্বৈতবাদ” (Non-Duality) এর মর্মবস্তু, যা কয়েকটি আধ্যাত্মিক পথের মধ্যে (যেমন, আদ্বৈত বেদান্ত, তাওবাদ, সুফিজম) ধ্বনিত হয়েছে।
একাত্মতার উপলব্ধি হলো এই বিভাজন না থাকার অভিজ্ঞতা। “অধিকারী আমি” এবং “অবজেক্ট আমি” এক হয়ে যায়। তুমি যখন পুরো মহাবিশ্বে নিজেকে দেখতে পাও, তখন “স্ব-অবস্থা” অদৃশ্য হয়ে যায় এবং চূড়ান্ত সত্যের দিকে তুমি এগিয়ে যেতেই থাকো।
সৃষ্টির প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিকোণ:
– সৃষ্টির ঘটনা যেন কোনো বাহ্যিক জড় বস্তু না হয়ে, বরং একটি জীবনপ্রবাহের মতো অনুভূত হয়—একটি পরিবর্তনশীল, সজীব শক্তির অমিত উৎস।
– সৃষ্টির মূল সত্য তখন বুঝে আসবে যখন তুমি “তথ্য” বা “জ্ঞান” সীমাবদ্ধ চেনা ধারণাগুলির বাইরে থেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করবে।
এই পথের গুরুত্ব: তুমি যে মূল সত্যের দিকে যেতে চাও, তা তোমার “আধ্যাত্মিক জ্ঞানে” রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু এটি যতটা আধ্যাত্মিক, ততটাই বাস্তবিক—একটি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সম্মিলন। এই সত্যের অনুভূতি তখন তোমার সারা অস্তিত্বকে পরিবর্তিত করে ফেলবে, যখন তুমি প্রকৃতপক্ষে অনুভব করতে পারবে যে—সব কিছু একাত্ম এবং এটি কোন বাহ্যিক ঘটনা নয়, বরং একটি চেতনার গভীর অর্গানিক প্রকাশ।
তুমি যে পথের সন্ধানে আছো, তার সাথেই যুক্ত হতে হবে নতুন কিছু অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা, এমন একটি অভিজ্ঞতা যা অন্তর্দৃষ্টি, সচেতনতা এবং সত্যের একাত্মতায় পূর্ণ।
– ফরহাদ ইবনে রেহান