“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” গানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা,
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।
কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার,
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে,
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।
লালন সাঁই মানুষের আত্মসত্তা, দেহতত্ত্ব এবং চেতনার রহস্য অনুসন্ধানে যে জ্ঞানের পথ দেখিয়েছেন, তার অন্তরে রয়েছে “নিজেকে জানো” বাণী। তিনি দেহকে শুধু রক্ত–মাংসের পাত্র হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন জীবনের গূঢ়তম সত্যের মন্দির হিসেবে। “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” গানটি সেই অন্তর্জাগতিক অনুসন্ধানের এক অনন্য দলিল, যেখানে মানুষ, দেহ, আত্মা ও নিয়তি–সবকিছুকে প্রশ্নের আলোয় তুলে ধরা হয়েছে। দেহের ভেতর আত্মার উপস্থিতি, জন্ম–মৃত্যুর অদেখা পথ, মনের বশীভবন এবং নশ্বরতার স্মরণ—সব মিলিয়ে এটি জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধির আহ্বান।
গ্রাম বাংলার আনাচে, কানাচে, শহরের অলিগলিতে থাকা মোল্লা, পুরোহিত, চাকরি জীবী, চাষা, নির্বিশেষে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, প্রথাভেদ ভুলে আবাল, বৃদ্ধ, সকল নারী পুরুষ ই এই গানের সাথে পরিচিত।এটি কেবল গান ই নয় বাঙালী জাতির যুগ যুগান্তরের আবেগ, অনুভূতি, বিরহ প্রকাশের মাধ্যম। আমরা প্রায়ই শত ব্যস্ততার মধ্যে ও গানটি পুরোপুরি মুখস্থ না থাকলেও মনের অজান্তেই প্রথম অংশ গেয়ে ফেলি। কেননা আমাদের জাগতিক প্রয়োজন মেটানোর পরেও আমরা এক প্রকার শুন্যতায় ভুগি।যেন মনে হয় কি যেন আছে, আবার কি যেন নাই, কে যেন আছে, আবার কে যেন নাই। সেই ভাবনার অন্তহীন ভাবনায় বিভোর হয়ে ই আত্মার বিজ্ঞানী যুগাবতার মহা পুরুষ মহাধীমান মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজী দীর্ঘশ্বাস ফেলে অকপটে গেয়ে ফেলেছেন-
খাচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?
মহাত্মা ফকির লালন সাঁই এর হাতেখড়ি কার হাতে হয়েছিল এ নিয়ে মতামত পাওয়া গেলেও তিনি বিজ্ঞানের উপর কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী বা মাস্টার্স করেছেন তা জানা যায় না। অথচ তার রচিত এমন কিছু কালাম রয়েছে যেগুলো দেখলে ই মনে হয় এগুলো কোন উচ্চ পর্যায়ের ফিজিওলজিষ্টের সহস্র বছরের গবেষণার সংক্ষিপ্ত ফল। আজকে উনার রচিত বহুল প্রচলিত “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” গানটি নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান এবং যোগতত্বের সমন্বয়ে যৎসামান্য আলোচনা করবো।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।।
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”
খাঁচা – মানবদেহ। লালন সাঁই দেহকে একটি জীবন্ত খাঁচা বলে অভিহিত করেছেন। এটি শুধু হাড়–মাংস নয়, এটি আত্মার আবাস।দেহ সেই রহস্যময় স্থান যেখানে অদৃশ্য প্রাণ বা চৈতন্য অবস্থান করে, আবার একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।
অচিন পাখি- এই পাখি পরিচিত নয়, চোখে ধরা যায় না। এটি আত্মা/প্রাণ/চেতনা—যার আগমন ও প্রস্থান মানুষের বোধের বাইরে।জীবন কখন আসে, কখন চলে যায়- মানুষ জানে না। এই রহস্যই “অচিন”।
“কেমনে আসে যায়”
আত্মা কোথা থেকে আসে, কোথায় ফিরে যায়, এ প্রশ্নই মানব অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু।জন্মের রহস্য, মৃত্যুর রহস্য, উভয়ই অজ্ঞাত। লালন সাঁই বলেন, এ জ্ঞান যুক্তি বা পণ্ডিতির দ্বারা পাওয়া যায় না; অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে আসে।
“তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি”
তারে – সেই অচিন পাখি, পরমাত্মা কে। ধরতে পারলে- আত্মার সত্য রূপ ধরতে পারা মানে নিজেকে জানা- “আত্মজ্ঞান”। এখানে ধরার মানে দেহের বাইরে কোনো বস্তু ধরে ফেলা নয়; নিজের সত্য স্বরূপ উপলব্ধি করা।
মনবেড়ি– আত্মাকে ধরা সম্ভব নয়, কিন্তু মনকে সংযত করলে আত্মজ্ঞান জাগ্রত হয়। “মনবেড়ি” মানে মনকে শৃঙ্খলিত করা- রাগ, লোভ, অহং, কামনা, বিভ্রম থেকে মুক্ত করা।মন নিয়ন্ত্রণেই আত্মানুভূতির পথ খুলে যায়।
“দিতাম পাখির পায়”
মনকে বেঁধে ফেলতে পারলে আত্মার সত্য উপলব্ধি স্থিতিশীল হতো।আত্মা পাখির মতো, বন্ধন চায় না। কিন্তু মনকে অধীনে আনলে চেতনাকে স্থির করে সেই রহস্য জানা যায়।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।।
“আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা”
আট কুঠুরি – মানবদেহকে আট ভাগের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।বাউল-লালনবা দেহতত্ত্বে এটি দেহের প্রধান রহস্য-অবস্থান, শক্তিকেন্দ্র ও অভ্যন্তরীণ গোপন স্তরের ইঙ্গিত। এটি শুধু শারীরিক গঠন নয়; মানস–প্রাণ–চিত্ত–বুদ্ধির আধ্যাত্মিক স্তরও এর মধ্যে নিহিত।
আট কুঠুরী দিয়ে রুপক ভাবে আটটা ঘর বা আটটা কোঠা বোঝালেও মুলক ভাবে দেহের আটটা গ্রন্থি বা আটটি বিশেষ ষ্টেশন কে বোঝানো হয়েছে। সাধু মহলে এই আট কুঠুরীর দু রকম বা তার ও অধিক তথ্য বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তবে গুরু প্রণীত মতাদর্শ অনুযায়ী ভাষা এবং কার্যকরণে পার্থক্য থাকলেও তাদের অবস্থান নিয়ে তেমন মতপার্থক্য নেই বললেই চলে। আমি এখানে সর্বাধিক পঠিত এবং আলোচিত দুটি মতের সবিস্তারে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
প্রথমত:
১. পিটুইটারী–
পিটুইটারি গ্রন্থি মস্তিষ্কের গোড়ায় অবস্থিত একটি মটর আকারের। এটিকে কখনও কখনও মাস্টার গ্রন্থি বলা হয় কারণ এটি শরীরের অন্যান্য অনেক গ্রন্থি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি হরমোন তৈরি করে যা বৃদ্ধি, রক্তচাপ, প্রজনন এবং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যোগ মতে, আজ্ঞা চক্র। যার অবস্থান ভ্রু যুগলের মধ্যবর্তী স্থান। কাজ – জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি।
২. থাইমাস-
থাইমাস হলো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি বিশেষ প্রাথমিক লিম্ফয়েড অঙ্গ। থাইমাসের মধ্যে থাইমাস কোষ, লিম্ফোসাইট বা টি কোষ পরিপক্ক হয়। টি কোষ অভিযোজিত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে শরীর বহিরাগত আক্রমণকারীদের সাথে খাপ খায়। থাইমাস বুকের উপরের অংশে অবস্থিত।
যোগমতে, অনাহত চক্র বা হৃদয় চক্র।হৃদয়চক্র করুণা, ভালোবাসা, সমন্বয় ও সুরক্ষার শক্তি বহন করে
আত্মিকভাবে এই চক্রকে জীবনীশক্তি ও আত্মরক্ষার কেন্দ্র বলা হয়।
৩. থাইওয়েড গ্রন্থি –
থাইওয়েড গ্রন্থি বা থাইরয়েড হল দুইটি লোব দ্বারা গঠিত একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যার অবস্থান গ্রীবাতে। পুরুষের এডাম’স এপলের ঠিক নিচে এর অবস্থান। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনগুলো মেটাবলিক রেট ও প্রোটিন সিন্থেসিসকে প্রভাবিত করে। তার কাজ হল প্যারাথরমোন রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এবং ক্যালসিয়ামের পুনঃশোষণ বাড়িয়ে দেয়। রক্তে ফসফেটের মাত্রা সিমীত রাখতে সাহায্য করে এবং ভিটামিন D কে সক্রিয়করণে ভুমিকা পালন করে। ভিটামিন D এর অভাবে মানুষের রিকেটস রোগ হয়।
যোগ মতে, বিশুদ্ধি চক্র। এই চক্র ব্যক্তির প্রকাশ, সত্য বলা, যোগাযোগ ও সত্তার ছন্দনিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র।
৪. প্যারাথাইরয়েড–
প্যারাথাইরয়েড হল চারটি ছোট গ্রন্থির একটি সেট যা থাইরয়েড গ্রন্থির পিছনে অবস্থিত এবং শরীরের ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থিগুলো প্যারাথাইরয়েড হরমোন (PTH) নিঃসরণ করে, যা অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায়, কিডনিতে ক্যালসিয়ামের পুনঃশোষণ বাড়ায় এবং হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নির্গমনকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অতিরিক্ত বা কম কার্যকলাপ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
যোগ মতে এটি ও বিশুদ্ধ চক্রের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।
৫. অ্যাড্রিনাল –
অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি শরীরের উভয় পাশে পেরিটোনিয়ামের পেছনে বৃক্কের উপরে অবস্থিত। মানবদেহে ডান পাশের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিটি পিরামিড আকৃতির এবং বাম পাশের গ্রন্থিটি অর্ধচন্দ্রাকার। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি বিভিন্ন হরমোন ক্ষরণ করে যেগুলো বিভিন্ন এনজাইমের মাধ্যমে হয় গ্রন্থির ভেতরে নতুবা দেহের অন্যান্য অংশে বিপাকিত হয়। এই হরমোনগুলো বিবিধ অত্যাবশ্যক জৈবিক কাজের সাথে জড়িত।
যোগমতে, মণিপুর চক্র। মণিপুর চক্র দেহের বল, আত্মনিয়ন্ত্রণ, শক্তি ও প্রেরণার কেন্দ্র। উভয়ের অবস্থান নাভি-উপরের এলাকায়।
৬. প্যারোটিড –
প্যারোটিড গ্রন্থি হল একটি লালা গ্রন্থি যা মুখের সামনের অংশে, কানের নিচে অবস্থিত। এটি শরীরের বৃহত্তম লালা গ্রন্থি এবং এটি লালা তৈরি করে যা খাদ্যকে হজম করতে সাহায্য করে। জিহ্বার নিচে, জিহ্বার উপরে, এবং বৃক্কে প্যারোটিড গ্রন্থি পাওয়া যায় না। যোগ মতে, এটিও বিশুদ্ধ চক্রের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
৭. প্যানক্রিয়াস –
প্যানক্রিয়াস হলো প্রানীদেহের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বা পরিপাকতন্ত্রের একটা বিশেষ অঙ্গ যা একই সাথে খাদ্য হজমে বা পরিপাকে সহায়তা করে এবং ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন নিঃস্বরনকারী গ্রন্থি হিসেবেও কাজ করে। বাংলায় একে অগ্নাশয় নামে পরিচিত করা হয়েছে। প্রানীদেহে এর অবস্থা পাকস্থলির শেষে যেখানে ডিওডেনামের শুরু, তার ঠিক নিচে।
যোগ মতে, মণিপুর চক্র। মণিপুর চক্র দেহের রূপান্তরশক্তি, পাচনশক্তি, জীবনীশক্তি ও আগুনতত্ত্বের কেন্দ্র।
৮. ডিম্বাশয় –
ডিম্বাণু উৎপাদনকারী একটি প্রজনন অঙ্গ এবং স্ত্রী প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ। মেরুদণ্ডী প্রাণীতে এটি সাধারণত একজোড়া করে থাকে। ডিম্বাশয় পুরুষের শুক্রাশয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এতে গোনাড ও অন্তঃক্ষরা উভয় প্রকার গ্রন্থি-ই রয়েছে।
বয়ঃসন্ধিতে, ডিম্বাশয়ে হরমোনের ক্রমবর্ধমান মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য হরমোন প্রতিক্রিয়া বিকশিত শুরু করে। ডিম্ব উৎপাদন ও প্রজনন করার ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। ডিম্বাশয়ের গঠনের কাঠামো এবং কার্যাবলীর পরিবর্তন শুরু হয় বয়ঃসন্ধিতে।
যোগ মতে,
স্বাধিষ্ঠান চক্র। প্রজনন, সৃজনশক্তি, কামশক্তি, আবেগ ও স্নিগ্ধতার কেন্দ্র। ডিম্বাশয় যৌন হরমোন, প্রজনন ও নারীত্বের শারীরিক প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাধিষ্ঠান চক্র সৃষ্টির শক্তি ও প্রাণরসের আধার।
দ্বিতীয় মত অনুযায়ী আট কুঠুরী-
এখানে আট কুঠুরী হল মানুষের শরীরের আটটা পাত্র বা রক্তনালী, রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার একটি অংশ এবং সারা শরীর জুড়ে রক্ত পরিবহনের জন্য কাজ করে এমন আটটি ষ্টেশন। পূর্বেই বলেছিলাম, ভাষাগত মতপার্থক্য থাকলেও স্থানগত তেমন বিশেষ পার্থক্য নেই। তবুও সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমি দ্বিতীয় মত নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
১. খুলি –
করোটি বা খুলি বলতে একটি অস্থিনির্মিত কাঠামোকে বোঝায়, যা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মাথা গঠন করে। এটি মুখমণ্ডলের কাঠামো বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ক রক্ষাকারী গহবর তৈরি করে। করোটির অংশ দুটি: করোটিকা (ক্রেনিয়াম, cranium) এবং চিবুকাস্থি (ম্য্যান্ডিবল)
যোগ মতে, সহস্রার চক্র। মস্তিষ্কের শীর্ষে, মাথার মুকুটস্থানে অবস্থিত। করোটি মস্তিষ্ককে ধারণ ও সুরক্ষা দেয়।
সহস্রার চক্র চেতনাবোধ, আত্মজ্ঞান ও পরম উপলব্ধির কেন্দ্র। শারীরিকভাবে করোটি যেমন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষাকবচ, সহস্রার তেমনি চৈতন্য ও আধ্যাত্মিক শক্তির সর্বোচ্চ স্তর।
২, ৩. ফুসফুস –
ফুসফুস মেরুদণ্ডী প্রাণীর একটি অঙ্গ যা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই শ্বাসযন্ত্রটির প্রধান কাজ হলো বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্তপ্রবাহে নেওয়া এবং রক্তপ্রবাহ হতে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বাতাসে নিষ্কাশন করা। এই গ্যাস আদান-প্রদান করা হয় বিশেষায়িত কোষ দ্বারা তৈরী, খুবই পাতলা দেয়াল বিশিষ্ট লক্ষাধিক বায়ু থলির দ্বারা যাকে অ্যালভিওলাই বলে। এর শ্বাসকার্য ছাড়া অন্য কাজও আছে।
যোগ মতে,
অনাহত চক্র।অনাহত চক্রের মূলতত্ত্ব প্রেম, প্রাণশক্তি, শ্বাস-প্রবাহ ও জীবনধারণের ছন্দ।
৪. হৃদপিন্ড –
হৃৎপিণ্ড অধিকাংশ প্রাণীতে একটি পেশীবহুল অঙ্গ, যা পৌনঃপুনিক ছন্দময় সংকোচনের মাধ্যমে সংবহনতন্ত্রের রক্তনালির মধ্য দিয়ে সারা দেহে রক্ত পাম্প করে।
যোগ মতে, এর অবস্থান ও অনাহত চক্রে।
৫. পাকস্থলী –
পাকস্থলী (ইংরেজি: Stomach) মানব দেহে পরিপাকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা অন্ননালী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে অবস্থিত। এটি উদর গহবরের বাম পাশে উপর দিকে থাকে। খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়া প্রধানত পাকস্থলীতে শুরু হয়। বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে পাকস্থলীর ভূমিকা প্রধান। যোগ মতে, মণিপুর চক্র। এ চক্র দেহের প্রাণশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আগুনতত্ত্বের কেন্দ্র।
৬, ৭. বৃক্ক বা কিডনি (ইংরেজি: Kidney) –
মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা দেহের রেচন তন্ত্রের প্রধান অংশ। এর প্রধান কাজ রক্ত ছেঁকে বর্জ্য পদার্থ (যেমন ইউরিয়া) পৃথকীকরণ ও মূত্র উৎপাদন। মানব দেহের সমুদয় রক্ত দিনে প্রায় ৪০ বার বৃক্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও দেহে পানি ও তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ বা ইলেকট্রোলাইট যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদির ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া এটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসাবে হরমোন নিঃসরণ করে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
যোগ মতে, মূলাধার চক্র। এ চক্র নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, জীবনধারণের ভিত্তি ও শারীরিক স্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. কোলন বা বৃহদন্ত্র –
বৃহদন্ত্র, বৃহৎ অন্ত্র নামেও পরিচিত, যা গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল নালীর এবং মেরুদন্ডীদের পরিপাকতন্ত্রের শেষ অংশ। পানি এখানে শোষিত হয় এবং অবশিষ্ট বর্জ্য পদার্থ মল হিসেবে সংরক্ষণ করে মলত্যাগ এর পূর্ব পর্যন্ত।
যোগ মতে, এটা ও মুলাধার চক্রের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
“নয় দরজা আঁটা”
দেহের নয়টি ছিদ্র-দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসারন্ধ্র, মুখ, মলদ্বার, জননেন্দ্রিয়।এসব দিয়ে বাহ্যজগতের যোগাযোগ।লালন সাঁই বলেন, এই নয় দরজার মধ্যে সত্তা বন্দি, যেমন খাঁচা।বাস্তবে দরজা “খোলা”, কিন্তু রহস্য “আঁটা”—অর্থাৎ জ্ঞানহীন; সত্য দেখা যায় না।
“মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা”
দরজার মাঝে জালি বা কাঁটা—ইন্দ্রিয়ের বাধা/ভ্রম/আবরণ।চোখ আছে, কিন্তু সত্য দেখতে পারে না;
কান আছে, সত্য শুনতে পারে না।কাঁটা মানে কামনা–বাসনা–মোহের ঘেরা জগত।সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব, কিন্তু সরাসরি ধরা কঠিন।
“তার উপরে সদর কোঠা”
দেহের সর্বোচ্চ কেন্দ্র, মস্তিষ্ক/সাহস্রার/চেতনার আসন।এখানে জ্ঞানের দরজা খুলে।“সদর” মানে প্রধান, আসল কক্ষ।আত্মবোধের রাজপ্রাসাদ। যোগতত্বের ষটচক্রের একটি।
“আয়নামহল তায়”
আয়নামহল – আত্মদর্শনের স্থান।এখানে মন নিজেকে দেখে, আয়নার মতো যেমন ভাবে অন্য কে দেখে।
সত্য-চেতনার প্রতিফলন এখানে ঘটে; আত্মপরিচয় এখানেই জাগে। বাহিরে নয়, ভিতরে দৃষ্টি, তখন জগতের ও সত্তার প্রকৃতি দেখা যায়। যোগতত্বের আজ্ঞাচক্র বা দ্বিদল পদ্ম নামে পরিচিত।
কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।।
“কপালের ফ্যার নইলে কি আর”
“কপালের ফ্যার” অর্থ নিয়তি, দূর্ভাগ্য, পূর্বসঞ্চিত সাধনফল বা কর্মফল।
লালন বলছেন- এই আত্মা/প্রাণসত্তার এমন বিচিত্র আচরণ বোঝা বা উপলব্ধি করা সবার ভাগ্যে হয় না। এ যেন পূর্ব জন্মের কর্মফল বা এ সংকট পূর্ব নির্ধারিত।
“পাখিটির এমন ব্যবহার”
অচিন পাখি (আত্মা) দেহে এসে থাকে, আবার চলে যায়, এই আচরণ মানববোধের অতীত। প্রাণ আসে, প্রাণ যায়, এ রহস্য মানুষের নিয়ন্ত্রণে নয়।তার চলন স্বতন্ত্র, পরম-নিয়ন্ত্রিত। যখন থাকে তখন ও ধরা দেয়না, দেখা দেয় না। আবার চলেও যায় পাষন্ডের মত।
“খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার”
দেহ নষ্ট হোক বা না হোক তার ইচ্ছা মত সকল বন্ধন ছিন্ন করে সকল মায়ার প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে যায় আপন গতিতে। এখানে মৃত্যু চিহ্নিত হয়েছে।
খাঁচা ভাঙা = দেহের অবসান, জীবনপ্রবাহের সমাপ্তি।
“কোন বনে পালায়”
আত্মা কোথায় যায়?এ প্রশ্ন আধ্যাত্মিক দর্শনের গভীর কেন্দ্র। পুনর্জন্ম? নাকি পুনরোথ্থান? নাকি নিরাকারলোকে মিলন? নাকি ফের নিজ উৎসে প্রত্যাবর্তন? মানুষ জানে না। লালন প্রশ্ন তুলছেন, মৃত্যুর পর চৈতন্য কোন জগত-প্রকৃতিতে প্রবাহিত হয়?
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।।
“মন তুই রইলি খাঁচার আশে”
মন দেহের প্রতি আসক্ত। দেহকেন্দ্রিক বাসনা, ভোগ, অহংকার, সম্পদ–বিলাস, সম্মান এসবের আশে থাকে।লালন বলছেন, মন দেহকে স্থায়ী ভেবে ভুল করে;সত্যের পথে না গিয়ে দেহজ আকাঙ্ক্ষায় আটকে থাকে।
“খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে”
দেহ অস্থায়ী ও ভঙ্গুর।“কাঁচা বাঁশ” অর্থ, যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে।দেহের ভরসা ভুল ভরসা,
এটি টেকসই নয়, টেকানো যায় না।
“কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে”
মৃত্যু অবধারিত।একদিন দেহ ভেঙে পড়বে, ইন্দ্রিয় বন্ধ হবে, প্রাণ বিদায় নেবে।কখন হবে কেউ জানে না।
সুতরাং দেহ-আসক্ত মনকে সাবধান বাণী শোনানো হচ্ছে।
“ফকির লালন কেঁদে কয়”
এখানে লালনের কান্না দর্শনগত, আবেগ নয়, সতর্কতা। মানুষ ভ্রমে পড়ে সত্য ভুলে যায়।
আত্মসত্যের ডাকে সাড়া না দিয়ে দেহভোগে ডুবে থাকে। লালন তাই নীরব হাহাকার করে বলেন-
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…”
অচিন পাখি ধরা পড়ে না; দেহের খাঁচা ভেঙে একদিন সে চলে যায় অজানা পথে। মানুষ এই রহস্যের প্রবাহমান প্রহেলিকার মধ্যে বেঁচে থাকে, অথচ ভুলে যায় নিজের অন্তর্গত সত্যকে। লালন সাঁই স্মরণ করিয়ে দেন, দেহ নশ্বর, মন ভ্রমে আবদ্ধ, কিন্তু আত্মা অমর। তাই আত্মচেতনা ও মনের সাধনা ছাড়া মুক্তি নেই। এই গান আমাদের শুধু শুনতে নয়, ভাবতে শেখায়, আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় ফিরে যাব। নিজেকে জানার এই সাধনাই মানবজীবনের প্রকৃত সার; সেই আহ্বানেই লালনের বাণী আজও অনন্ত দীপশিখার মতো জ্বলছে।
লেখা- মোহন






