সুফি ও সুফিবাদ কাকে বলে?

সুফি ও সুফিবাদ কাকে বলে?

সুফি কাকে বলে?:
১. সুফি মানে সাদা, সহজ, সরল পবিত্র, নির্মল। পবিত্র সত্তার অধিকারী। যিনি তাসাব্বুরে শায়েখের মাধ্যমে তাজকিয়াতুন নফস অর্জন করেছেন তিনিই সুফি।

২. যিনি আপন ইচ্ছে শক্তিকে আল্লাহর ইচ্ছার নিকট মিটিয়ে দিয়ে মুক্ত হয়েছে তাকে সুফি বলা হয়।

৩. আপন মুর্শিদের ধ্যানে স্বীয় নফসকে কুফর ও শিরিক মুক্ত স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল, কোমল ও পবিত্র চরিত্রে অধিকারীকে সুফি বলা হয়।

৪. যিনি শয়তানের ধোঁকা হতে মুক্ত তিনি সুফি।

৫. যে সাধক স্বীয় নফস থেকে শয়তানকে তাড়িয়ে সার্বজনীন হয়ে গেছেন তিনিই সুফি।

৬. যে সাধক আপন ইচ্ছা ও আকাঙ্খা আপন রবের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে মিটিয়ে দিয়েছেন তাকে সুফি বলা হয়।

সুফিবাদ কাকে বলে?:
১. আত্মশুদ্ধির দর্শনকে বলা হয় সুফিবাদ।

২. নফস থেকে খান্নাসকে তাড়িয়ে আল্লাহর হুকুম রূহকে জাগ্রত করার প্রয়োগ পদ্ধতিকে বলা হয় সুফিবাদ।

সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:
পদার্থবিদ্যা গবেষণার হিশাবের উপর দাঁড়িয়ে অগ্রসর হতে থাকে। লৌহের দেহের মরিচার আবেষ্টনী অগ্নির স্পর্শে, ধাক্কার আঘাতে আপনিই ঝরে পড়ে। তেমনি পদার্থবিদেরা গবেষণার অগ্নি ও আঘাতের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নূতনের দিকে এগিয়ে যান। এটাই পদার্থবিদ্যার ধর্ম।

অনেক ধর্মের অনেক আবেষ্টনী সার্বজনীন সুফিবাদকে ঢেকে দিতে যুগে যুগে চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু সুফিদের সত্য অগ্নি ও ধাক্কার আঘাত সংকীর্ণতার অবগুণ্ঠন হতে সুফিবাদকে মুক্ত করে এনেছে। কখনও কখনও আপন ধর্মে জন্মগ্রহণ করে আপন ধর্মের আনুষ্ঠানিক প্রভাবগুলো হতে মুক্ত করতে গিয়ে সুফিদের কাফের নামক বিশেষণে ভূষিত হতে হয়েছে। এই একটি স্থানেই কি বলা যায় না যে, যে- ধর্মে সুফি জন্মগ্রহণ করেছে সেই ধর্মটাই সুফির আজন্ম পাপ?

আজ হতে পাঁচ হাজার বছর আগে জমদগ্নি মুনি সুফিবাদের যে অমৃত বাণীটি ঘোষণা করে গেছেন সেই একই বাণী ইহুদি ধর্মের সুফি, খ্রিস্টান ধর্মের সুফি এবং সবশেষে ইসলাম ধর্মের সুফিদের কণ্ঠে এক, অখণ্ড, অদ্বিতীয়, অদ্বৈত দর্শনটি প্রতিফলিত হয়েছে।

সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হলো আপন নফসের সঙ্গে, আপন প্রাণের সঙ্গে, আপন জীবাত্মার সঙ্গে যে-খান্নাসরূপী শয়তানটিকে পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে উহা হতে মুক্তিলাভ করা।

এই মুক্তির প্রশ্নে প্রয়োগপদ্ধতির বিভিন্নতা থাকতে পারে, বাক্যের শৈলীর অবগুণ্ঠনে চাকচিক্য থাকতে পারে, বিভিন্ন রকম কথা- বর্ণনা-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে, কিন্তু মূল দর্শনে আপন নফ্সটিকে খান্নাসমুক্ত করা; কারণ আপন নফসের অভ্যন্তরে খান্নাসটির অবস্থানই বিতর্কিত বহু মতবাদ, দর্শন, সাহিত্য, কবিতা যুগে যুগে রচনা করে গেছে।

সুতরাং ফেনোমেনাল সিভিলাইজেশন তথা আপাত দর্শনীয় সভ্যতার জনকটি হলো খান্নাসরূপী শয়তান। খান্নাসের বিরুদ্ধে যত রকম কথা, যুক্তি প্রদর্শনই থাক না কেন, অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে খান্নাস থাকবেই। যেদিন খান্নাসের অস্তিত্বটি হারিয়ে যাবে সেদিন ফেনোমেনাল সিভিলাইজেশন তথা বিত্ত-বৈভবের তথাকথিত সভ্যতাটিও হারিয়ে যাবে।

বিবর্তনবাদের ধাপে ধাপে খান্নাসও রঙ-রূপ বদলিয়ে বদলিয়ে অগ্রসর হয়। খান্নাসের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি? আদৌ কি এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, যাবে? ধরে নিলাম খান্নাসের অস্তিত্ব নাই, কিন্তু শক্তির উপর শক্তি- এভাবে মহাশক্তি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের মতো বিশ্বের মানুষগুলোকে খান্নাসের হাতের মুঠোয় রাখতে পারে।

এই খান্নাসি শক্তিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করাটি সহজ কাজ নয়। তাই যারা খান্নাসের আসল পরিচয়টির মোটামুটি ধারণা নেবার পর তাকে তাড়িয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ধ্যানসাধনায় মগ্ন হয়, তারাই জেহাদ করার একেকজন ঝানু সৈনিক। এই জেহাদকেই জেহাদে আকবর বলা হয়। এই জেহাদের প্রথম ও প্রধান অস্ত্রটির নাম হলো ‘দায়েমি সালাত’ তথা অবিরাম যোগাযোগের প্রচেষ্টা।

এই অবিরাম যোগাযোগের প্রচেষ্টা যারা চালিয়ে যায়, তাদেরকেই বাংলা ভাষায় ‘যোগী’ বলা হয়, আর আরবি ভাষায় বলা হয় ‘মুসল্লি’। ভাষার ভিন্নতায় সাধারণ মানুষ হিন্দুত্বের গন্ধ পায়, আবার মুসলমানিত্বের গন্ধও পায়। এই ভাগ বিভাজনে কাষ্ঠ প্রকৃতির মানুষগুলোই আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করতে গিয়ে সংকীর্ণতার বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। গণ্ডির চিন্তায় কূপমণ্ডুকতা প্রকাশ পায় এবং এখান থেকেই মতভেদের বিন্দু মারামারির বৃত্তে পরিণত হয়।

ক্রুসেডের যুদ্ধটি বোধ হয় এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উভয় দলই জেহাদ নামের সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে জেহাদি জোশের ডামাডোল বাজিয়ে ‘জেহাদ করা হচ্ছে’ বলে প্রচার করেছিল। আসলে উহা ছিলো নিছক যুদ্ধ, মোটেও উহা জেহাদ নয়। কারণ উহার মধ্যে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ শব্দটি ছিলো না- থাকলেও মৌখিক, আন্তরিক নয়। খান্নাস-মুক্তির জেহাদই জেহাদে আকবর তথা সর্বশ্রেষ্ঠ জেহাদ। এই জেহাদে মরণ নাই। ফানার দেহটি দেহ বলেই মনে হয় আসলে উহা নির্বাণপ্রাপ্ত তথা ফানাফিল্লাহর দেহ।

দুধ হতে যেইমাত্র মাখন বের করে নেওয়া হয়, তখন দুধ আর দুধ থাকে না, স্থুল চোখে উহা দুধই মনে হবে, কিন্তু পান করতে গেলেই ধরা পড়ে যায়। ধরা পড়ে যায়- এটা ঘোল, কিন্তু দেখতে দুধের মতো । ‘আনা বাশারুম মিসলেকুম’-এর রহস্যটি দুধ আর ঘোলের মতো, আসলে বিরাট পার্থক্য। একটি মাখন-মিশ্রিত দুধ, আরেকটি মাখন-উঠানো ঘোল। খান্নাস – মুক্তির ধ্যানসাধনাটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সমাজ ইহাকে গ্রহণ করুক আর না-ই করুক, কিন্তু ইহা নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

সমাজের সব মানুষই যদি খান্নাসমুক্ত হয়ে পড়ে তা হলে আর আল্লাহর পরীক্ষাটি থাকে না, তাই সুফিরা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে মেজাজি বলেন আর অপরদিকে খান্নাসমুক্তির ধ্যান সাধনাটিকে হাকিকি বলেন।

সূত্র: নিহ্নবে চিত্তাহ, (সুফিবাদ সার্বজনীন), সুফি দার্শনিক আল্লামা কলন্দর জাহাঙ্গীর ইকাবাল ইবনে হেলাল।

নিবেদক: আর এফ রাসেল আহমেদ

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel