ওলি-সূফিদের কলকাতা।
– আসিব মিয়া
এদিকে আমাদের যাত্রীবাহী বাসটি চলছে মারকুইস স্ট্রিটের দিকে। বাসটির শেষ গন্তব্য মারকুইস স্ট্রিট। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশীরা মারকুইস স্ট্রিটে আসেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর এই কলকাতা। কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়ে থাকে। হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে কলকাতা শহরটি অবস্থিত। দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎতম অর্থনীতির শহর এই কলকাতা। তৎকালীন সময়ে এই বাংলা ছিল সুজলা, শস্য-শ্যামলা অপরূপ সৌন্দর্য্যের আধিপত্যের সাম্রাজ্য। উপমহাদেশের এই ধন-সম্পদের আকর্ষণ বিদেশিদের আগ্রহী করে তোলে। এরই প্রেক্ষিতে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দ্য-গামার এই দেশের আসার পরপরই পর্তুগিজরা এদেশে আসা শুরু করেন। একে একে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমারদের শেষে সর্বশেষ এদেশে আসেন ইংরেজরা। প্রায় ২০০বছর ইংরেজরা এদেশ শাসনের মাধ্যমে ইংরেজের পতন হলেও থেকে গেছে অনেক কিছুই। এসবের স্থাপত্যশৈলি সাড়া ভূভারত জুড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো এই কলকাতা শহর ১৯১১সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল।
হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতায় রয়েছে যেমন বিভিন্ন মঠ-মন্দির, গির্জা-গুরুদুয়ার, তেমনি রয়েছে মুসলিম স্থাপত্যের অসংখ্যক নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের আগমন ঘটে উনবিংশ শতাব্দীতে। তাঁরমধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলা, মালদহ জেলা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলাতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি।
কলকাতায় বশরী শাহ মসজিদ, নাখোদা মসজিদ, মওলা আলী শাহ দরগা, ইমামবাড়াসহ রয়েছে অসংখ্যক সুফিপীরের মাজার। এছাড়াও ভারতের রাজধানী দিল্লিতে রয়েছে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) এর মাজার, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর মাজার, আমীর খসরু (রহ.) এর মাজার, মির্জা গালিব (রহ.) এর মাজার,
মটকা পীরের মাজার, ঐতিহাসিক কুতুব মিনার, দিল্লি ইমামবাড়া, দিল্লি জামে মসজিদ, ঈসা খাঁর কবর, লাল কেল্লাসহ আগ্রায় অবস্থিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তাহমজল এবং মুসলিম স্থাপত্যের অসংখ্যক স্থাপনা। রাজস্থানের আজমেরী শহরে অবস্থিত উপমহাদেশের ইসলাম প্রচারক, তরিকায়ে চিশতীয়ার প্রবর্তক হযরত খাজা মঈনুদ্দিন হাসান চিশতি (রহ.) এর মাজার শরীফ, সৈয়দ মিরান হোসাইন (রহ.) এর মাজার, গফুর আলী শাহ (রহ.) এর মাজার, বড়পীরের খানকা, আড়াইদিনের ঝুপড়ি, তাড়াগড় পাহাড়, আনাসাগর লেক সহ আজমেরীর বিখ্যাত হোসাইনী ইমামবাড়া ইত্যাদি আরো দর্শনীয় মুসলমানের তীর্থভূমি। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্যক তীর্থযাত্রী কলকাতা দিয়ে দিল্লি এবং আজমেরী শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
যাবতীয় ব্যস্ততার মাঝেও এই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম। মুসলমানদের এইসব তীর্থস্থান দেখা ও আজমেরী শরীফ জিয়ারত করার অভিলাষে ছিলাম অনেক আগে থেকেই। উপন্যাস এবং সিনেমায় দেখা কলকাতা, দিল্লি, রাজস্থানকে স্বচক্ষে দেখার কৌতুহলেরও কমতি ছিল না। এসবের উদ্দেশ্যে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২২ইং সন্ধ্যায় ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকাগামী মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেসে করে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছালাম। সেখান থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে করে রওনা হলাম সীমান্তবর্তী বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। রাত এগারোটা পনেরো মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেসটি ঢাকা থেকে ছেড়ে পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় গিয়ে পৌঁছাল বেনাপোল স্টেশনে। বেনাপোল স্টেশন থেকে সরাসরি চলে গেলাম ইমিগ্রেশনে।
ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতীয় ভূখণ্ডের বনগাঁর প্রেট্রাপোল এসেছি সদ্য।
এদিকে আজ থেকে দূর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতাও শুরু হয়েছে দুদেশে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজার এই সময়ে ভারত-বাংলাদেশ ভ্রমণে যান। সেই সুবাদে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই পূজার মৌসুমে লোকজনের সমাগম একটু বেশি হয়ে থাকে বেনাপোল স্থলবন্দরে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ইমিগ্রেশন শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখা মিললো অনেক লোকজনের। তারা আমাদের দেখে নানাভাবে ডাকাডাকি শুরু করল। অনেকে আবার জোড়াজুড়িও করতে থাকে। তাই যতটুকু সম্ভব সর্তকতার সাথে থাকলাম। কিছু বাংলাদেশী টাকা ভাঙিয়ে ইন্ডিয়ান রুপি করে নিলাম।
ভারতীয় ভূখণ্ডে বনগাঁ’র প্রেট্রাপোল এসে দেশ ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে কলকাতায় যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কিনেছি। প্রতিটি টিকেট এর মূল্য ২০০রুপি করে নিল। এসি বাস বিধায় ভাড়া একটু বেশি। এছাড়াও প্রেট্রাপোল থেকে অটোতে করে বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশন থেকে কলকাতার শিয়ালদাহ স্টেশন পৌছানোর জন্য ট্রেন পাওয়া যায়। তাতে খরচ কম পড়ে। প্রেট্রাপোল থেকে বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ৭.৭কিলোমিটার। শরীর অনেকটা ক্লান্ত বলে গাদাগাদি করে ট্রেনে যেতে ইচ্ছে হলো না। তাই বাসে করে রওনা হলাম কলকাতা শহরের উদ্দেশ্যে। দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের ২৪পরগনার বিভিন্ন সড়ক অতিক্রম করে বাসটি চলছে কলকাতা শহরের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে বিকাল চারটায় স্থানীয় ফুড পার্ক ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টে এসে থামলো বাসটি। সবাই নেমে যে যার মতো করে খাবার খেয়ে নিচ্ছে। পেটে খুব ক্ষুধা থাকায় রেস্টুরেন্ট থেকে ভাত খেয়ে নিয়েছি। একপ্লেট ভাত, সাথে সবজি, ও একটি রুই মাছের পিছ সহ মোট দাম নিল ১৪০রুপি। উল্লেখ্য, আমাদের বাংলাদেশের মতোই এখানে সবাই টাকাকে ‘টাকা’ বলে। একে একে বারাসাত, দমদম এয়ারপোর্ট, দমদম পৌরসভা, মধ্যমগ্রাম পৌরসভা পেরিয়ে বাসটি আচার্য জগদীশ চন্দ্রবোস রোডে চলছে। হঠাৎ করে বন্ধ জানালা দিয়ে বাহিরে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে যায়। সবুজ রঙের গম্বুজের পাশে উঁচু মিনার সহ একটি মাজার শরীফ। মাজারের নামটি পড়তে পড়তে আমি আরো চমকিয়ে উঠি। মাজারের টাইলসে লেখা ছিল- “মওলা আলী শাহ দরগা”। পাশেই মওলা আলী শাহ মসজিদ। মাজারটি জনৈক আধ্যাত্মিক সুফি পীরের। হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতা শহরের এই বুকচিরে স্থাপত্য মাজার শরীফটি মুসলমানদের অন্যন্য নিদর্শন। প্রাচীন নিদর্শনের দিক থেকে নাখোদা মসজিদটির চেয়ে কলকাতা শহরের প্রাচীনতম মসজিদ হলো বশরী শাহ মসজিদ। এটি শহরের ৮শেঠ পুকুর সড়কে অবস্থিত, যা নির্মিত হয়েছিল ১৮০৪সালে। এটিকে শতবর্ষী মসজিদও বলা হয়ে থাকে। ইরাকের বশরা শহরের জনৈক সুফি পীর বশরী শাহ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। উক্ত পীরের উফাতের পর ভক্তরা মসজিদের পাশেই তাঁর মাজার স্থাপন করেছেন। বশরী শাহ মসজিদের মতোই ঐতিহাসিক প্রাচীন শতবর্ষী মসজিদ হলো কলকাতার টালিগঞ্জের কেওড়া পুকুর এলাকার “বড় মসজিদ”। আনুমানিক ১৮৭ বা ততোধিক বছরের পুরোনো মসজিদটি মূলত সুন্নি মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদের গম্বুজটি ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরলভী শরীফের আলা হযরত এর মাজারের হুবহু নকশা করা। ঐতিহ্য ও আধুনিক এবং নান্দনিকতার ছোঁয়ায় মুসলমান সহ সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের মনোরঞ্জনকারী মসজিদ হলো নাখোদা মসজিদ। কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদটি দর্শনে আসেন অসংখ্যক পর্যটক। তৎকালীন সময়ে ভারতীয় পনেরো লাখ রুপির খরচে প্রতিষ্ঠিত নাখোদা মসজিদটি কলকাতা শহরের সর্ববৃহৎ মসজিদ। মোঘল সম্রাট আকবরের সমাধি সৌধের অনুকরণে মসজিদটি নির্মাণ করেন সুন্নীরা। আব্দুর রহিম ওসমান নামক ব্যাক্তির অর্থায়নে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আব্দুর রহিম ওসমান ছিলেন একজন সুন্নী মুসলমান ও সমুদ্র বণিক। ধারণা করা হয় তাঁর নামনুসারে এই মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘নাখোদা মসজিদ’। জনশ্রুতিতে আছে, নাখোদা শব্দের অর্থ হলো- নাবিক।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, কলকাতা শহরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫০টির অধিক মসজিদ রয়েছে। তন্মধ্যে বশরী শাহ মসজিদ, টালিগঞ্জের বড় মসজিদ, জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখোদা মসজিদ, রাজাবাজার বারী মসজিদ, কুলুটোলা মসজিদ ও লাল মসজিদ, মারকুইস লেনের আহলে হাদিস মসজিদ, রাফি আহমেদ কিদওয়াই সড়কের হাবিব-উল-মসজিদ, পার্ক সার্কাস স্ট্রিটে মসজিদে মোহাম্মদী, হাক্কানী মসজিদ, মীর্জা গালিব স্ট্রিটে মদীনা মসজিদ, পার্ক স্ট্রিট নুরানি মসজিদ, মল্লিকবাজার জামে মসজিদ, রানী শংকরী লেনে হাজরা মসজিদ, যদু বাজার মসজিদ, খিদিরপুর মদিনা মসজিদ, মারকুইস স্ট্রিট কলিন লেনের জামা মসজিদ কালাঙ্গা, স্টেট ব্যাংক কলোনির বকুলতলা মসজিদ, মমিনপুর রোডে হাজি আমজাদ আলী মসজিদ, বারিশায় শাহানি বেগম মসজিদ, জোহরা বেগম মসজিদ, আহমাদিয়া মসজিদসহ রয়েছে লেলিন স্মরণি রোড টিপু সুলতান মসজিদ। টিপু সুলতান মসজিদটির কথা লিখতেই মনে পড়ে গেলো নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের কথা। তসলিমা নাসরিনের বির্তকিত ‘লজ্জা’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড ‘শরম’ উপন্যাসে উল্লেখ করেন, যে তসলিমা নাসরিনকে জুতোর মালা পরাতে পারবে তাঁকে বিশ হাজার টাকা দিবে বলে ফতোয়া দেন টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম!
তাছাড়া শহরের মেটিয়াবুরুজ এলাকায় রয়েছে কারবালা মসজিদ। কারবালা মসজিদটি শিয়া সম্প্রদায়ের হলেও সুন্নি শিয়া এই দু’সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রতি বছর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ১০ই মুহররম পবিত্র আশুরা উদযাপন করেন। এছাড়া কলকাতা শহরের অনেক মসজিদ, ইমামবাড়া, মাজার শরীফে শাহাদাত কারবালার স্মরণে তাজিয়া, শোকসভা, অনুষ্ঠিত করে আসছে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। কলকাতা শহরের মেটিয়াবুরুজের “কারবালা মসজিদ” ছাড়াও একই নামকরণে শহরের ওয়াটগঞ্জেও রয়েছে আরেকটি কারবালা মসজিদ। সেখানে রয়েছে ইমামবাড়া। আমি যে সময়টায় কলকাতায় ছিলাম তখন আরবি হিসেবে ছিল রবিউল আউয়াল মাস। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনের মাস। সুন্দর ও ফজিলতপুর্ণ সময়ে আমাদের বাংলাদেশের মতো কলকাতার মুসলিমরাও ১২ই রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.) এর আগমন উপলক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) বেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপন করে থাকে তাঁরা। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কলকাতায় ‘নবি দিবস’ নামে বেশ পরিচিত। কলকাতার অনেক জায়গায় দেখেছি, প্রতিটি মুসলিমরা তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে সবুজ রঙের পতাকা উড়িয়ে আলোকসজ্জা করে।
কলকাতা শহরে সন্ধান মিলে বিভিন্ন ইমামবাড়ার। শহরের তিরেত্তি’তেও রয়েছে বাসরাভি মসজিদ ও ইমামবাড়া। এছাড়া বউবাজারের ওয়েস্টন স্ট্রিটে আছে ‘বারগাহ-এ-ইমাম হোসাইন (আ.) ইমামবাড়া’, মানিকতলার ‘হুসেইনি দালান ইমামবাড়া’, বেনিয়াপুকুর ‘চান্দ বিবি ইমামবাড়া’, তালতলার ‘বারো নাম্বার ইমামবাড়া’, বড়বাজার বটতলার ‘কারবালা ইমামবাড়া’, নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ রোডের সিবতাইনবাদ ইমামবাড়া। এই ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেন লখনৌয়ের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। ব্রিটিশরা নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের রাজত্ব কেড়ে নিলে পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় এসে বসবাস স্থাপন শুরু করেন। এবং প্রতিষ্ঠিত করেন এই ইমামবাড়াটি। এই ইমামবাড়াতেই রয়েছে তাঁর সমাধিস্থল।
কলকাতা শহরের বাহিরে হুগলি জেলায় রয়েছে বাংলার সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া ‘হুগলি ইমামবাড়া’। বাংলার বিখ্যাত দানবীর হাজি মহসিন এই ইমামবাড়ার প্রতিষ্ঠাতা। হাজি মহসিন ১৮৪১ সালে এই ইমামবাড়া ও মসজিদের কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ২০বছর পরে এই ইমামবাড়া কাজ সমাপ্ত হয়। এই ইমামবাড়ার পাশেই রয়েছে হাজি মুহসিনের সমাধি। মুর্শিদাবাদ জেলায় ঐতিহাসিক হাজার দুয়ারির সাথে ও ভাগীরথী নদীর কাছেই রয়েছে বাংলার আরেকটি বৃহত্তম ‘নিজামত ইমামবাড়া’। এটিকে মুর্শিদাবাদ ইমামবাড়াও বলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় তৎকালীন সময়ে বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলার নির্মিত এই ইমামবাড়া। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনার মাঝে এই ইমামবাড়াটি আজও অক্ষত আছে। তবে মুর্শিদাবাদ জেলার ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্যমতে, নবাব সিরাজ উদ-দৌলার নির্মিত ইমামবাড়াটি ইংরেজরা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তী সময়ে এই স্থানে ‘নিজামত ইমামবাড়া’ প্রতিষ্ঠিত করেন নবাব মনসুর আলী খান।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই নয়, সতেরো শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে বাংলাদেশের ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠে ঐতিহাসিক হোসেনী দালান। মাধ্যমিকে অধ্যয়ণ করার সময় ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ নামক পাঠ্যবই-এ পড়েছিলাম, ঢাকা শহরের গোড়াপত্তনকারী সুবেদার শায়েস্তা খাঁন ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই হোসেনী দালান ইমামবাড়াটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রায় তিনশ সাতচল্লিশ বছরের পুরোনো এই ইমামবাড়াটি মোগল আমল এবং মুসলমানদের ঐতিহ্যের প্রতীক বহন করছে। মসজিদ, মাদরাসা, ইমামবাড়া, ফলক, তোরণসহ অসম্ভবনীয় সৃষ্ঠিকর্মের মাধ্যমে মুসলমানদের যে ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া তা সত্যিই গর্বের। আধুনিতে কালের ক্রমাগত বিবর্তনে সাধারণ মুসলমানদের কে ইমামবাড়া থেকে বিমুখ করা মূর্খতা ও অজ্ঞতার পরিচয়। শুধু মসজিদ, মাদরাসা-ই নয়, ইমামবাড়া, স্মৃতিসৌধ, সমাধি সৌধ, তোরণ, ইসলামি ভাষ্কর্যগুলো মুসলমানদের ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।
শুধু নির্দিষ্ট ভাবে ইমামবাড়া গুলোতেই কারবালার শোক অনুষ্ঠান আশুরা পালিত হয় না। কলকাতার বিভিন্ন সুফিদের দরগা, মাজার ও খানকা শরীফে ইসলামী ইতিহাসের তাৎপর্যময় দিনগুলি পালিত হয়ে আসছে।
হিন্দু অধ্যুষিত এই নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অজানা অলি-সুফিদের মাজার শরীফ। তন্মধ্যে সেগুলো হলো:- মওলা আলী শাহ’র মাজার,
দরবার শরীফ কলকাতা ও খানকাহ শরীফ মেদিনীপুর, তপসিয়ায় পাঞ্জাতন দরগা, মেটিয়াবুরুজের সুফি মহিদ শাহের মাজার, আর্চায জগদীশ চন্দ্রবোস রোডে সৈয়দ মিস্ত্রি আলী শাহ (র.) এর মাজার, দাতা বাবার মাজার, সৈয়দ মাদার আলী শাহ কাদেরি (র.) এর মাজার, ট্যাংরা মাজার শরীফ, তপসিয়া রোডে জোড়া মাজার, জুম্মা পীরের মাজার, কুদরত শাহ বাবা (র.) এর মাজার, খানকাহ নেয়ামতি মাজার, বাগদাদী শাহ বাবা (র.) মাজার, হযরত হামজা ওয়ালি শাহ (র.) এর মাজার, রজ্জব আলী শাহ (র.) এর মাজার, সৈয়দ জালাল শাহ বাবা (র.) এর মাজার, মানিক পীর বাবা (র.) এর মাজার, হযরত সূফি সৈয়দ ফতেহ আলী শাহ (র.) এর মাজার, হযরত গোলাম গাউস বাবা (র.) এর মাজার, মতি শাহ বাবা (র.) এর মাজার, তাঁত শাহ বাবা (র.) এর মাজার, সৈয়দ মাদার আলী শাহ কাদেরী (র.) এর মাজার, হযরত শাহ মোহাম্মদ খান বাবা (র.) এর মাজার, হযরত বারেস্তা বাবা (র.) এর মাজার, গাজি বাবা (র.) এর মাজার, হযরত সুফি শাহ জামিল আহমেদ কাদেরী বাবা (র.) এর মাজার, সৈয়দ বুদ্দাহ বাবা (র.) এর মাজার, তোতা শাহ বাবা (র.) এর মাজার, দাতাজি মওলানা সুফিউল্লাহ (র.) এর মাজার, হযরত মাওলানা খাইরুদ্দিন শাহ (র.) এর মাজার, আম্মাজান মাজার শরীফ, যশোহর রোড মাজার শরীফসহ অজানা সুফিদের মাজার ও খানকা শরীফ। কলকাতা শহরের বাহিরে মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে সুফি হযরত আলী আব্দুল কাদের সৈয়দ শাহ মুরশিদ আলী কাদেরি উরুফে মওলা পাক (র.) এর মাজার। মওলা পাক (র.) তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পাবনা এবং ঢাকা অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করেন।
বাংলাদেশের ঢাকার রাজবাড়ী, কুষ্টিয়াতে মওলা পাক (র.) এর অনেক ভক্ত মুরিদ রয়েছে। বিগত ১২০বছর ধরে মওলা পাকের উরুসে রাজবাড়ী থেকে একটি ট্রেন পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে যায়। মওলা পাক (র.) মাজার শরীফেও প্রতি বছর নবী দিবস, ঈদে গাদির ‘মাওলার-অভিষেক’, ১০ই মুহররম আশুরা, ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম উদযাপন হয়। ঢাকার হোসেনী দালান, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, খুলনা জেলাসহ দেশের সর্বত্র ১০ই মুহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাজিয়া মিছিল হলেও পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে এই মুহররম শরীফ সূচনা হয় আজ থেকে প্রায় সাতশ বছরের অধিক সময়ে হযরত শাহ জালাল (র.) এর সহচর সঙ্গী সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দীন (রহঃ) এর ঐতিহাসিক তরফ রাজ্যে (বর্তমান সিলেট) এ আগমনের মাধ্যমে। সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার অধস্থন পুরুষ ছিলেন সৈয়দ আলাই মিয়া আল হোসাইনী (র.)। নয় কোষা জমিদারী দেখাশুনার দ্বায়িত্বে পূর্বাঞ্চলের অষ্টগ্রামে আসেন তিনি। সেখানে স্রষ্টার সাধনায় সিদ্ধ হয়ে নয় কোষা জমিদারীত্ব ত্যাগ করেন। এবং প্রায় ২৫০বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে প্রথম মুহররম তথা পবিত্র আশুরা উদযাপন করেন। পরবর্তী সময়ে মুহররম শরীফ উদযাপন ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর সিলেট বিভাগ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লাসহ আশেপাশে।
চলতে চলতে আমাদের বাসটি এতোক্ষণে মারকুইস স্ট্রিট এসেছে। বাস থেকে নেমে থাকার জন্য হোটেলের সন্ধান করতে লাগলাম। এই মারকুইস স্ট্রিটে থাকার জন্য অনেক গেস্ট হাউস ও হোটেল রয়েছে। মারকুইস স্ট্রিটের পাশেই কলিন লেন। কলিন লেনের মাজার গলির একটি গেস্ট হাউসে আপাতত থাকার বন্দোবস্ত হলো। কলিন লেনের বেশিরভাগ মানুষই মুসলমান। এবং এই কলিন লেনের মাজার গলিতে একটি মাজার রয়েছে। মাজারটি হযরত সৈয়দ জালালউদ্দিন শাহ বাবা নামের জৈনক সুফি পীরের। মাজারগলিটা খুবই সরু একটা গলি। এই গলির প্রতিটি পরিবার মুসলিম। এই বসতিপূর্ণ স্থানে ছোট্ট পরিসরে সৈয়দ জালালউদ্দিন শাহ বাবার মাজার। মাজারটি ঠিক গেস্ট হাউসের নিচতলার গেইটের পাশে। হিন্দু অধ্যুষিত নগরীতে অলি-সুফিদের মাজার শরীফ জিয়ারত করে সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছি। কত আনন্দ, আবেগ ও প্রেম তা লেখা সম্ভব নয়।