প্রার্থনার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের যুগ-যুগান্তরের বাসনা ও ভীতি।

প্রার্থনার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের যুগ-যুগান্তরের বাসনা ও ভীতি।

প্রার্থনা—এই শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের যুগ-যুগান্তরের বাসনা ও ভীতি। অধিকাংশ মানুষের কাছে এটি এক প্রকার অদৃশ্য দর-কষাকষি, যেখানে জীবনের আপদ-বিপদ থেকে মুক্তি, অথবা পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য ঈশ্বরের অনুগ্রহকে আহ্বান জানানো হয়। প্রার্থনা যেন এক বাসনা পূরণের কৌশল, এক অলৌকিক সমাধান যা আমাদের নিজেদের কর্মের দায় থেকে মুক্তি দিতে পারে—এই হলো সাধারণের ধারণা। আমরা আরাম, সম্পদ, জ্ঞান—সবকিছুই বাইরে থেকে ভিক্ষা করতে চাই, কারণ আমরা স্বয়ং সেই ‘হওয়া’-এর পরিশ্রম থেকে বাঁচতে চাই।

সত্য, যা চিরন্তন এবং স্বয়ংসিদ্ধ, তা কখনওই ভিক্ষালব্ধ হতে পারে না। সত্যকে উপলব্ধি করতে হয়, সত্য হতে হয়। আমরা সেই ‘হওয়া’-এর পথে অগ্রসর না হয়েও যখন শুধু ফল পেতে চাই, তখনই প্রার্থনার এই প্রাবল্য দেখা যায়। এটি আসলে আমাদের স্বেচ্ছাকৃত দীনতা এবং আত্ম-রূপান্তরের ভীতি থেকে জন্ম নেয়। আমরা ভেতরের শূন্যতাকে বাইরের প্রাচুর্য দিয়ে পূর্ণ করতে চাই।

ঈশ্বরের জ্ঞান ও মানুষের আর্তি

ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞাতা এবং অন্তর্যামী হন, তবে তাঁর কাছে চাওয়ার ধৃষ্টতা কেন? তিনি তো প্রতিটি হৃদয়ের স্পন্দন, প্রতিটি অব্যক্ত বাসনা জানেন। বিশ্বচরাচর তাঁর স্ব-আরোপিত বিধানে পরিচালিত—তাতে মানুষের পরামর্শের স্থান কোথায়? যিনি অনাদি ন্যায়-এর প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি কি মানুষের ক্ষণিকের অশ্রু বা যুক্তির প্রভাবে তাঁর নীতির পরিবর্তন ঘটাবেন?

যদি তাঁর ন্যায়বিচারে পরিবর্তন আসে, তবে তিনি আর অপরিবর্তনীয় পরম সত্তা থাকেন না। তাঁর ন্যায়বিচার তখন মানুষের আবেগের ক্রীড়নক হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যে দুঃখ বা অশান্তি ভোগ করি, তা তো আমাদেরই কর্মফল; আমাদেরই ত্রুটি ও পাপের প্রতিচ্ছবি। এই ফল ভোগ না করে, ন্যায় বিচারকে প্রত্যাহার করার জন্য প্রার্থনা করা, কি অন্যায়ের সমান্তরাল নয়? এটি আসলে নিজ কর্মের দায় অস্বীকার করে অন্যায়ভাবে বিশেষ সুবিধা লাভের চেষ্টা।

যে জন স্বীয় ত্রুটি স্বীকার করে কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর বিধানকে বরণ করে নেয় এবং আত্ম-সংশোধনে উদ্যোগী হয়, কেবল তারই ওপর ঈশ্বরের নিগূঢ় করুণা বর্ষিত হয়। বীজ বপন না করে ফসল প্রত্যাশা করা যেমন মূর্খতা, মন্দ কর্ম করে সুফল কামনা করাও তেমনি ঈশ্বরের প্রকৃতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ।

প্রার্থনার উচ্চতর স্তর: হৃদয়ের গান

অতএব, প্রার্থনা কেবল ‘কিছু চাওয়ার’ কৌশল নয়। প্রার্থনা হলো ‘হওয়া’ বা অস্তিত্বের প্রকাশ। এটি হলো নিজের অন্তরস্থ সত্তাকে পরমাত্মার সামনে উন্মোচন করা—একটি নিবেদন। এটি কোনো প্রত্যাশা থেকে নয় যে, ঈশ্বর শুনলে খুশি হবেন; বরং এই কারণে যে, যখন হৃদয় তার নিজের গানটি পরিবেশন করে, তখন আত্মার ভার লাঘব হয়, মন প্রশান্ত হয়। এই গানটি বাইরের কোনো শ্রোতার জন্য নয়, এটি নিজেদের আত্মার নিরাময়।

পবিত্র গ্রন্থে আছে: “আমি তোমাদের প্রাণরগের চেয়েও বেশি নিকটবর্তী।”

প্রশ্ন জাগে: কার কান দিয়ে তিনি শোনেন? কার চোখ দিয়ে তিনি দেখেন?

উত্তর: তিনি আমারই কান দিয়ে শোনেন, আমারই চোখ দিয়ে দেখেন।

কারণ, স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক অদ্বৈত সত্যের অংশ। যিনি প্রেরক, তিনিই প্রাপক। প্রার্থনাকারী এবং প্রার্থনা শ্রবণকারী—উভয়েই এক ও অভিন্ন সত্তার দুই প্রকাশ। আমরা আসলে আমাদের নিজেদের সর্বোচ্চ সত্তার কাছেই প্রার্থনা করি—যে সত্তা আমাদের সকল জাগতিক আবরণের আড়ালে সদা বিরাজমান।

প্রার্থনা হলো দেহের খাদ্য, মনের স্থিরতা এবং আত্মার পরম বিশ্রাম। এখানে জাগতিক কিছু চাওয়া অসার, কারণ প্রাপ্তির পরেই বোঝা যায়, যা চাওয়া হয়েছিল, তা আসলে ক্ষুদ্রতা বা ভুল আকাঙ্ক্ষা মাত্র।

মনুষ্যত্বের সম্প্রদান ও অদ্বৈতের উপলব্ধি

যে মানুষ পশুত্ব ত্যাগ করে মনুষ্যত্বের স্তরে উন্নীত হতে পারে না, তার প্রার্থনা কবুল হয় না। কারণ, যে সত্তা কেবল খাদ্য, প্রজনন এবং স্থূল প্রবৃত্তি বোঝে, সে স্রষ্টার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে না। মনুষ্যত্বের প্রথম দাবি হলো: নিজের পরিবার ও প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, মানুষের সেবা করা। এটিই ঈশ্বরের সেবার আদি রূপ।

এই সেবার মাধ্যমে যখন মন পরিশুদ্ধ হয়, তখনই হৃদয় উচ্চতর প্রার্থনার জন্য প্রস্তুত হয়। সেই উচ্চতর প্রার্থনা হলো—নিঃশর্ত সমর্পণ, হৃদয়ের সম্প্রদান। এখানে চাওয়া বা পাওয়ার কোনো হিসেব নেই। এর অর্থ হলো ‘আমি তোমার হলাম’, এই বোধে সম্পূর্ণভাবে মিশে যাওয়া।

সম্প্রদান হলো ‘আমি-তুমি’ ভেদজ্ঞানকে বিলীন করে, দুইকে এক করে দেওয়া। প্রার্থনা হলো এই আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া—যা আরবিতে ‘আকিমুস সালাহ’ নামে পরিচিত। সৃষ্টি ও স্রষ্টা তখনই অদ্বৈত হয়, যখন হৃদয় উন্মুক্ত হয় এবং চিন্তা ও অনুভূতির প্রতিটি স্পন্দন এই মিলনের জন্য প্রস্তুত থাকে।

সম্পর্ক যখন সুগভীর হয়, তখন আর কিছু চাইতে হয় না। প্রেমাস্পদ স্বয়ং প্রেমিকের নিগূঢ় প্রয়োজন জানেন। প্রার্থনা তাই চাওয়া নয়, প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ—যা দুই সত্তাকে একীভূত করে পরম শান্তিতে বিলীন করে দেয়।

– ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel