ঈশ্বর মারা গেছেন (God is dead)
“ঈশ্বর মারা গেছেন” (God is dead) এই উক্তিটি ফ্রিডরিখ নিটশে (Friedrich Nietzsche) এর এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারণা, যা তার “Thus Spoke Zarathustra” (১৮৮৩–১৮৮৫) এবং অন্যান্য লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। নিটশে এই উক্তি দিয়ে ঈশ্বরের মৃত্যু বা ধর্মের প্রভাব ও আধিপত্যের অবসান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যা আধুনিক যুগের এক শক্তিশালী দার্শনিক ও সামাজিক ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উক্তির মূল বিষয়: নিটশে “ঈশ্বর মারা গেছেন” বলেছেন মূলত এই অর্থে যে, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব আর আধুনিক বিশ্বের দর্শন, বিজ্ঞান, এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে না। এটি ছিল একটি প্রতীকী উক্তি, যার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে:
ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়: আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তিবাদী চিন্তা, এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের জন্য ধর্মকে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। সমাজে ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ধর্মীয় আদর্শের প্রতি বিশ্বাসের স্থান কমে গেছে, এবং মানুষ তার নৈতিক মূল্যবোধ ও জীবনধারা অন্য জায়গা থেকে অনুসন্ধান করছে।
ঈশ্বরের মৃত্যু-সমাজের মানসিকতা: নিটশে এই উক্তি দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, ঈশ্বর বা ধর্মীয় ধারণা আর মানুষের জীবন ও সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। এই “মৃত্যু” মানবজীবনের অর্থের পরিবর্তন, মূল্যবোধের বিচ্যুতি, এবং নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। নিটশে মনে করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মৃত্যু শুধুমাত্র ধর্মীয় ধারণার পতন নয়, বরং মানুষের স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতা, এবং নতুন মূল্যবোধের সন্ধান পাওয়ার এক সুযোগ।
নতুন মূল্যবোধের জন্ম: নিটশে বলেছিলেন যে, ঈশ্বরের মৃত্যু মানবতাকে একটি নতুন নৈতিক পথ অনুসন্ধানে উৎসাহিত করবে, যা মানুষকে নিজের সৃষ্টিশীল ক্ষমতার দিকে পরিচালিত করবে। তিনি উপরিউক্ত চূড়ান্ত সত্তা বা ঈশ্বরের জায়গায় “Übermensch” (অথবা “অতিমানুষ”) ধারণার কথা বলেছেন, যার মাধ্যমে মানুষ তার পূর্ণ সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করবে এবং নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করবে।
ঈশ্বরের মৃত্যুর পরিণতি: নিটশে নিশ্চিতভাবেই বুঝেছিলেন যে, যখন একটি সমাজ ঈশ্বরের বা ধর্মের শাসন থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে নতুন নৈতিকতা, উদ্দেশ্য, এবং জীবনধারা খুঁজে বের করতে হবে। তবে তিনি এই পরিবর্তনকে সহজ বা সমস্যা-মুক্ত মনে করেননি; বরং এটি এক ধরনের উত্তেজনা, সংগ্রাম এবং সম্ভাব্য অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে, যদি মানুষ নতুন ধরণের নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।
নিটশের “ঈশ্বর মারা গেছেন” -এর সামাজিক প্রভাব: নিটশের এই উক্তি আধুনিক দর্শন ও সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে আধুনিকতাবাদ, পোস্টমডার্নিজম এবং নিউ অ্যাথিজম এর বিকাশের ক্ষেত্রে। একদিকে, এটি ধর্মীয় মূল্যবোধের অবসান এবং যুক্তিবাদী চিন্তার উদ্ভবকে চিহ্নিত করে, অন্যদিকে, এটি সেই শূন্যতার কথা বলে, যেখান থেকে মানুষ নতুন মূল্যবোধ এবং উদ্দেশ্যের সন্ধান করে।
শেষ কথা:
“ঈশ্বর মারা গেছেন” নিটশের একটি গভীর দার্শনিক উক্তি, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের পতন এবং আধুনিক মানুষের চিন্তা ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে। এটি ধর্ম, নৈতিকতা, এবং আধুনিক সমাজের দিকে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি খুঁজে পাওয়ার কথা বলে।
– ফরহাদ ইবনে রেহান
২৪/০১/২০২৫