উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর কলেজ (ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন)

উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর কলেজ (ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন)

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরের হুগলি নদীর তীরে আট নম্বর উইলিয়াম কেরি রোডে শ্রীরামপুর কলেজ দেশ – বিদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষার আদি শিক্ষালয়। ১৮১৮ সালের ১৫ জুলাই উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড নামে ত্রিরত্ন মিশনারির পুরোহিতদের উদ্ভবের অভিপ্রায়ে ভারতীয় খ্রিস্টানদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, এখানে এশীয় খ্রিস্টান এবং অপরাপর যুবকদেরকে সমান ভাবে প্রাচ্য বিদ্যা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান পাঠদান করা।

তৎসময়ে হিন্দু কলেজে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা সামান্য ছিল। এই শিক্ষা ধনী শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য ব্যবস্থা বলবৎ ছিল না। উইলিয়াম কেরি এবং তাঁর সহযোগীগণ সর্বসাধারণের জন্য একটি শিক্ষালয়ের আশু প্রয়োজন অনুভব করেন। তাঁরা স্বীয় অর্থ দ্বারা দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে কলেজ ভবনটি তৈরি করেন। এটিই ছিল প্রথম ভারতের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক কলেজ যেখানে ধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় একই ছাদের নীচে স্থান পেয়েছে। ৩৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ‘শ্রীরামপুর কলেজ”- এর কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়। প্রথমে মিশন ভবনে ক্লাস অব্যাহত ছিল। মেজর উইকেডি ভবনের নকশা তৈরি করলেন।

অতঃপর লর্ড হেস্টিংস তা অনুমোদন দেন। ডেনমার্কের রাজা প্রদত্ত কারুকার্য খচিত লোহার গেট ও দোতলায় ওঠার জন্য মনোরম ডিজাইনের দুটি সিঁড়ি কলেজে আসে। ১৮২২ সালে রাজকীয় স্তম্ভ এবং অতিসুন্দর পোর্টিকো হুগলি নদীর পশ্চিম তীর বরাবর ডেনিশ সরকারের অর্থ সাহায্যে সাত একর জমির উপর দ্বিতল কলেজ ভবন নির্মাণ হয়ে গেল। উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের সঙ্গে জন ম্যাক-সহ চারজন একত্রে উৎসাহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। ১৮২৩ সালের ৭ মার্চ কলেজে উইলিয়াম ওয়ার্ডের অকাল মৃত্যু হয়। শ্রীরামপুরে ভয়াবহ বন্যার কবলে কলেজের ক্ষতি হয়। ১৮২৬ সালে মার্শম্যানকে ডেনিশ রাজার সমীপে প্রেরণ করা হয়।

১৮২৭ সালে ডেনিশ সরকার শ্রীরামপুর কলেজকে সম্মানজনক সনদ প্রদান করে, যার মান ইউরোপীয় কলেজের সমতুল্য হয়। একমাত্র শ্রীরামপুর কলেজই এশিয়ার মধ্যে প্রথম এই সম্মানের অধিকারী হয়। ১৮৩৩ সালে উইলিয়াম কেরি উক্ত সনদ বলে কলেজের সংবিধান তৈরিতে মনোযোগী হন। এইবার উইলিয়াম কেরির জীবনপ্রবাহ নিয়ে আলোকপাত করা যাক। উইলিয়াম কেরি ইংল্যান্ডের নর্দাস্পটনশিয়ারের কাউস্ট্রিটাউ সেন্টারের অদূরে পার্লাসাপেরি গ্ৰামে ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট পৃথিবীতে আর্বিভূত হন। পিতা এডমন্ড কেরি, মাতা এলিজাবেথ উইলস, পিতামহ পিটার কেরি। পিতার পাঁচ সন্তান -উইলিয়াম, কেরি, অ্যান, মেরি টমাস ও এলিজাবেথ। শৈশবে পিতার অনুশীলনে বিদ্যাচর্চা শুরু হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্ৰিস, ল্যাটিন, গণিত ও ধর্মশাস্ত্রে অধ্যয়নে পারদর্শিতা লাভ করেন। দারিদ্র্যতা হেতু পড়াশোনা অসমাপ্ত করে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। পারিবারিক পেশা জুতো সেলাইয়ের কাজে সংযুক্ত হন।

১৯৭৯ সালে সি. টি গোল্ডের দোকানে কর্মচারী নিয়োগ হন। ১৭৮১ সালের ১০ জুন কেরি ভরোথি প্ল্যাটার্ডকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৭৮২ সালে নর্দাস্পাটনের ব্যাপটিস্ট মন্ডলীর পালক সংঘে যোগদান করেন। ১৭৮৩ সালের ৫ অক্টোবর জন রাইল্যান্ড কেরিকে ব্যাপস্টিক মতে দীক্ষা দেন। ১৭৮৫ সালে মোলটনের একটি স্কুলে শিক্ষক পদে নিয়োগ হন। তিন সন্তান-ফেলিক্স, উইলিয়াম ও পিটারের জন্ম হয়। ১৭৮৯ সালে কেরি ধর্মযাজক বৃত্তি লাভ করেন। ১৭৯২ সালের ২ অক্টোবর ব্যাপস্টিক মিশনারি সোসাইটি সংগঠিত হয়। ১৭৯৩ সালের ১৩ জুন সপরিবারে কেরি ও টমাস ভারত সফরে আসেন। ১৭৯৪ সালে মালদহের মদনবাটি নীলকুঠিতে কেরি তত্ত্বাবধায়কের চাকরি নেন।

১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি খিদিরপুরের বাড়ি ত্যাগ করে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে অবস্থান করেন। ১৮০১ সালে্র ৪ মে কেরি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মনোনীত হষ। ১৮০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০৭ সালে পত্নী ডরোথীর অকাল মৃত্যু হয়। ১৮০৮ সালে শালটরুমকে দ্বিতীয় পত্নীর মর্যাদা দেন। ১৮০৯ সালে কাগজ ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন। ১৮১১ সালে এশিয়াটিক রিসার্চ প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালে দিকদর্পণ পত্রিকার প্রকাশক। ১৮২৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ থিওলজি বিভাগে সনদ লাভের শতবর্ষ পালিত হয়। ১৮২৯ সালে সতীদাহ নিবারক আইনের তিনি অনুবাদক। আমেরিকার ব্লাউন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক”ডক্টর অফ ডিভিনিটি” উপাধিতে শোভিত হন। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, বাংলা গদ্যরীতির প্রর্বতক পরলোকে পাড়ি দেন।

শ্রীরামপুর শহরের কালিতলা বাসস্ট্যান্ডের বামদিকে পিয়ারলেস অফিসের পেছনের সমাধিস্থলে মহান ব্যক্তিত্বে কবরস্থ করা হয় তার মৃত্যুতে কলেজ অভিভাবকহীন হয়। ১৮৪৫ সালে ডেনিশ সরকারের অবলুপ্ত ও জন ম্যাকের অকাল মৃত্যুতে পুনরায় শ্রীরামপুর কলেজ ভীষণ সমস্যায় পড়ে। উল্লেখ্য, ১৮৫৭ সালে শ্রীরামপুর কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভে কৃতার্থ হয়। ১৮৮৩ সালে ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটির প্রেরণায় কলেজে ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান হয়। সুতরাং কলেজটি প্রকৃতপক্ষে ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত কলেজে সংকট ঘনীভূত হয়। ১৯০৬ সালে কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হন জর্জ হাওয়েল। তাঁর সার্বিক প্রচেষ্টায় ১৯১০-১১ সালে কলেজের উন্নতি হয়।

এহেন সময় তিনি থিয়োলজি বিভাগ চালু করেন। এছাড়া কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ দুটি পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায়। ছাত্রাবাস ও ল্যাবরেটরি ভবন নির্মাণ হয়। শ্রীরামপুর কলেজ ‘বাংলার অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯১৫ সালে শ্রীরামপুর কলেজ থেকেই প্রথম ‘ব্যাচেলর অব ডিভিনিটি’ ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯১৮ সালে ‘স্যাডলার কমিশন’ শ্রীরামপুর কলেজ সম্পর্কে প্রশংসামূলক রিপোর্ট পেশ করে। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে শ্রীরামপুর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ স্নাতক স্তরে উন্নীত হয়। এহেন সময় খ্যাতনামা অধ্যাপকগণ হলেন, বীরেন ঘোষাল, হরিপদ শাস্ত্রী, রাধারমণ গাঙ্গুলী, কালীকৃষ্ণ মুখার্জী, এম.এন বিশ্বাস প্রমুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায় শ্রীরামপুর কলেজ ক্যাম্পাস ভবন মিলিটারি হাসপাতাল করার হেতু সরকার আয়ত্তে নেয়। পাঠাগারের সিংহভাগ অংশ স্থানান্তর করা হয় চন্দননগরে।

১৯৪৩ সালে কলেজ ৮ জন ছাত্রী-সহ উচ্চ মাধ্যমিকের কলা বিভাগ চালু করে। শ্রীরামপুর কলেজের সুবর্ণযুগের পত্তন হয় ১৯৪৬ সালে কলেজটির সরকার মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তে। ১৯৪৭ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৩৬ জন। ১৯৫৭ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৫২ জনে পৌঁছে যায়। ১৯৬১ সালে শ্রীরামপুর কলেজে মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উইলিয়াম কেরির দ্বি-শত জন্মবার্ষিকী উৎসব পালিত হয়। ১৯৯২ সালে ভারতে উইলিয়াম কেরির আগমনের দুইশত বছর এবং শ্রীরামপুর কলেজের ১৭৪ বছর পূর্তি উৎযাপন মহাসমারহে পালন করা হয়। ভারত সরকার স্মারকচিহ্ন হিসেবে ১৯৯৩ সালে বিশেষ ডাক টিকেট প্রকাশ করে। বর্তমানে এই কলেজে ২২৭৭ জন স্টুডেন্ট, ৭৯ জন অধ্যাপক, ৩০ জন শিক্ষাকর্মী আছেন।

– মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel