হোমপেজ আহলে বায়াত (পাকপাঞ্জাতন) মওলা আলী (আঃ)-ই হলেন রাসুল (সাঃ) এর ঘোষিত সর্ব প্রথম ইমাম

মওলা আলী (আঃ)-ই হলেন রাসুল (সাঃ) এর ঘোষিত সর্ব প্রথম ইমাম

মওলা আলী (আঃ)-ই হলেন রাসুল (সাঃ) এর ঘোষিত সর্ব প্রথম ইমাম

মওলা আলী (আঃ)-ই হলেন রাসুল (সাঃ) এর ঘোষিত সর্ব প্রথম ইমাম 

গাদিরে খুমের ঘটনা এমন একটি ঘটনা, ধর্মীয় ইতিহাসে যাহার গুরুত্ব ব্যাখ্যার কোন অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্র পরিচালকগণ এর গুরুত্ব সম্যক অবগত ছিলেন বলিয়াই সেখানে আগত অহিবাক্য দুইটি একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থান লাভ করিতে পারে নাই। ফলত প্রথম বাক্যটি হইতে মাওলার নাম বাদ দেওয়া হইয়াছে এবং শেষ বাক্যটি অন্যত্র অপ্রাসঙ্গিক একটি বড় বাক্যের মধ্যে আত্মগোপন করিয়াছে। উহা স্বতন্ত্র একটি “আয়াতরূপে ” অবস্থান লাভ করিতেও পারে নাই। এইরূপে গাদিরে খুমের অভিষেক ক্রিয়ার উল্লেখ কোরান হইতে এক প্রকার মুছিয়াই গিয়াছে।

পরবর্তী রাষ্ট্রীয় প্রচার চক্রান্ত তথা উমাইয়া এবং আব্বাসীয় চক্রান্ত এই বিষয়টির উল্লেখ সমাজের বৃহত্তম অংশের স্মৃতি হইতে মুছিয়া ফেলতে সক্ষম হইয়াছে, যদিও তাহা একেবারে মুছিয়া ফেলা সম্ভবপর হয় নাই। হাদীসে রাসুল এবং ইতিহাস আজও তাহার সাক্ষ্য বহন করিয়া আসিতেছে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় বিবাদ এবং রাষ্ট্রীয় বিবাদের মূল উত্সমুখ হইল ঐতিহাসিক এই অভিষেক ক্রিয়া। ইহা অমান্য করার পর হইতে মুসলমানের ধর্মমত ও পথ বিভ্রান্তির শত ধারায় বিভক্ত হইতে লাগিল। অতএব আরব জাতির ইতিহাস এবং আমাদের ইসলাম ধর্মের বিবর্তনের মূল সুত্র সন্ধান করিতে গেলেই মূল সুত্র সন্ধান করিতে গেলেই মনের মধ্যে জাগিয়া উঠবে গাদিরে খুম।

কোরানের অবতীর্ণ বাণীর সর্বশেষ বাক্য দুইটি গাদিরে খুমে নাজেল হইয়াছিল। তাহা ছিল নিন্মরূপ: ( ৫:৬৭) হে রাসুল, আপনার রব হইতে আপনার দিকে যাহা নাজেল করা হইয়াছে তাহা পৌছাইয়া দেওয়া হইল না। আল্লাহ আপনাকে মানবমণ্ডলী হইতে লইয়া আসিবেন নিশ্চয় আল্লাহ কাফের কওমকে হেদায়েত করেন না।

উক্ত নির্দেশ অনুযায়ী অভিষেক ক্রিয়া সেখানেই সম্পন্ন করা হইলে পর কোরানের শেষ আয়াত নাজেল হইল (যাহা ৫:৪ মধ্যখানে বসান হইয়াছে)

মক্কায় অবস্থিত সকলকে বিদায় সম্ভাষণ করিয়া নিজে এহরামের পোষাক না ছাড়িয়াই মদিনার পথে রওয়ানা হইলেন। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক তাঁহার সহযাত্রী ছিলেন। পথে ১৮ ই জিলহজ তারিখে যখন তিনি “গাদিরে খুম” নামক জায়গায় উপস্থিত হইলেন তখন এই আয়াত নাজেল হইল :-
হে রাসুল, আপনার রব হইতে যাহা নাজেল হইয়াছে তাহা পৌছাইয়া দিন। আর যদি না করেন তাহা হইলে তাঁহার (আল্লাহর) রেসালত পৌছাইয়া দেওয়া হইল না। আল্লাহ আপনাকে মানবমণ্ডিল হইতে লইয়া আসিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের দলকে হেদায়েত করেন না (৫:৬৭)! ইহা কোরআনের সব শেষের আগের আয়াত।

This verse of the Quran is the last but one according to chronology of time.

শেষ কথাটির প্রকৃত অনুবাদ হইল: আল্লাহ আপনাকে মনুষ্য হইতে (সরাইয়া) তাঁহার সঙ্গে লাগাইয়া লইতেছেন বা লইবেন।
ইহাতে বলা হইল: হে রাসুল, যে কথা আলীর মাওলাইয়াত ঘোষণা করার বিষয়ে নাজেল করা হইয়াছিল তাহা এখন পৌছাইয়া দিন। আর তাহা যদি না করেন তবে আল্লাহর রেসালত মানবমণ্ডীর নিকট পৌছাইয়া দেওয়া হয় না, কারণ শীঘ্রই আল্লাহ আপনাকে জননণ্ডলী হইতে তাঁহার গভীর সান্নিধ্যে টানিয়া লইয়া যাইতেছেন ; অর্থাৎ আপনার পার্থিব কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিতেছে। এমতাবস্থায় যদি নবুয়তের এন্তেজাম করার যোগ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়া জনগণের কাছে তাহাকে তুলিয়া না দেন তাহা হইলে আল্লাহর রেসালত জনগণের নিকট পৌছাইয়া দেওয়া হইল না।

“গাদির “অর্থ জলাশয়। জায়গার নাম খুম। খুমের জলাশয়ের নিকটবর্তী হইলে উক্ত আয়াত এইরূপে নাজেল হইয়াছিল: “ইয়া আইউহাব রাসুল বাল্লেগ মা উনজিলা ইলাইকা মির রাব্বেকা আন্না আলীউন মাওলাল মোমিনীন। অইন লাম তাফাল ফালা বাললাগতা রেসালাতুহু। আল্লাহু ইয়া ‘সেমুকা মিনান নাস।” ইহা হইতে “আন্না আলীউন মাওলাল মোমিনীন ” কথাটি কোরান হইতে বাদ দিয়াছে। মুসা নবীর সঙ্গে যেমন হারুনের (আ.) নামও উল্লেখ আছে, সেইরূপ আলীর (আ.) নামও আল কোরানে কয়েকবার ছিল। কিন্তু তাঁহার নামের উল্লেখসমূহ খলিফা ওসমানের (রা.) প্রকাশনা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে। (তাফসিরে দোররে মুনসুর – মোল্লা জালালউদ্দিন শিউতী, ২য় খণ্ড, মিশর থেকে প্রকাশিত)

(বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করার পর ১৮ জিলহজ তারিখে গাদিরে খুম নামক স্থানে) উটের উপরে বসিবার কয়েকটি আসন একের পর এক স্থাপন করিয়া মিম্বার তৈরি করা হইল। উহার উপর উঠিয়া রাসুল আ. জনতার নিকট অবতীর্ণ বাণী পেশ করিলেন, তারপর নিন্মলিখিত ছোট একটি ভাষণ দান করিলেন :-“আলাসতু আওলা বেকুম মিন আনফুসিকুম”?

(আওলা অর্থ নিজের জীবন হইতে যিনি অধিক প্রিয় এবং সর্ববিষয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত তিনি আওলা। যাহার জন্য প্রয়োজন হওয়া মাত্র জীবন উৎসর্গ করা ওয়াজেব।)

কালু: “বালা ইয়া রাসুলুল্লাহ আ:” অর্থাৎ অর্থাৎ আমি কি তোমাদের আপন জীবন হইতে অধিক আওলা নই? উত্তরে লোকেরা বলিল: হ্যাঁ হ্যাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ আ:। জনগণ হইতে এই স্বীকৃতি স্পষ্টভাবে লাভ করার পর তিনি আলীর (আ.) দুই বাহু ধরিয়া জনতার সম্মুখে তাহাকে শূন্যে তুলিয়া ধরিলেন এবং বলিলেন :”মান কুনতুম মাওলাহু ফাহাজা আলীউন মাওলাহু আল্লাহুম্মা ওয়ালে মান ওয়ালাহু, আদা মান আদাহু, অনসুর মান নাসারা, অখজুল মান খাজালা, ফাল ইয়াস হাদিল হাজেরুল খায়েরা। ”

অর্থাৎ “আমি যাহার মাওলা এই আলী তাহার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাহাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর যে তাহাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাহাকে শত্রু রূপে গ্রহণ কর যে তাহার সঙ্গে শত্রুতা করে এবং সাহায্য কর তাহাকে যে সাহায্য করে এবং লাঞ্চনা দাও তাহাকে যে লাঞ্চনা দেয়।”

জনতার মধ্যে “মারহাবা মারহাবা” পড়িয়া গেল। রাসুলের আ. আদেশ অনুসারে নব নিযুক্ত নেতার নিকট আসিয়া সকলেই আনুগত্যের বায়াত গ্রহণ করিল। হযরত ওমর রা. বায়াত গ্রহণ করিতে যাইয়া যে সুন্দর বাক্যটি মাওলা আলীর আ. প্রশংসায় উচ্চারণ করিয়াছিলেন তাহার উল্লেখ হাদিসে রহিয়াছে। তিনি বলিয়াছেন :বাখ খীন বাখ খীন ইয়া আলী ইবনে আবিতালেব…..ইত্যাদি। অর্থাৎ তুমি ধন্য ধন্য হে আবু তালেবের সন্তান আলী …ইত্যাদি।

তাহার কথার ভাবধারা এইরূপ ছিল:- আজ হইতে সকাল সন্ধ্যা প্রত্যেক মোমিন নরনারী কর্তৃক স্মরণীয় এবং প্রশংসিত হইয়া রহিলে। অর্থাৎ আল্লাহর এবাদত করিতে গেলে তাহার জন্য যে গুণকীর্তণ করিতে হয় তাহার সঙ্গে নবীর মাধ্যম ব্যতীত উহা গৃহীত হয় না। আজ হইতে আলী আ. সেই স্থানের অধিকারী হইলেন। আল্লাহর গুণকীর্তণের সঙ্গে মাওলার উছিলা এবং মাধ্যম অবলম্বন করিতেই হইবে এবং শাসন ইত্যাদি সর্ববিষয়ে মাওলার সহায়তা করিতে হইবে, কারণ তিনি হইলেন নবীর স্থলাভিষিক্ত।

এইরূপে যখন বায়াত গ্রহণের অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হইল এই আয়াত নাজেল হইল এবং ইহা হইল কোরআনের শেষ অবতীর্ণ আয়াত:-
আল ইয়াওমা ইয়া এসাইলাম আল্লাজীনা কাফারু মিন দ্বীনকুম ফালা তাখশাওহুম অখশাওনী। আল ইয়াওম আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম অ আতমাম তু আলাইকুম নেয়ামতী ওয়া রাজিতু লাকুমুল ইসলামাবাদ দ্বীনা। (৫:৪)

অর্থ :আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর রাজি হইলাম। (অর্থাৎ তোমাদের আত্মসমর্পন জনীত ধর্মের উপর বা নীতির উপর আমি সন্তুষ্ট হইলাম।)

উম্মতের মোহাম্মদীর দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণা এবং তাহাদের উপর আল্লাহর নেয়ামত দান করা বিষয়টি সম্পূর্ণ হইয়া গেল। তাই রাসুল পাক আ. আল্লাহর নিকট কর্তব্য সম্পাদনের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিলেন নিন্মে উল্লেখিত বাক্য উচ্চারণ করিয়া:- আল্লাহু আকবার। আল হামদো লিল্লাহি আলা আকমালে দ্বীনা ওয়া এতমামেন নেয়ামাতিন ওয়া রেজায়ে রাব্বি আলা রেসালাতী ওয়া বেলায়াতে আলী ইবনে আবু তালেব।

অর্থ :আল্লাহ মহানতর। দ্বীনকে কামেল করিয়া দেওয়ার উপর এবং নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করিয়া দেওয়ার উপর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এবং আমার রেসালতের (কর্তব্য পালনের) উপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং আবু তালেব নন্দন আলীর (আ.) বেলায়েতের জন্য সকল প্রশংসা আল্লাহর।

ভাষণদানকালে মঞ্চ্ এ উঠিয়া যখন আলীকে (আ.) দুই হাত তুলিয়া ধরিলেন তখন রাসুলের (আ.) শুভ্র বগল দেখা যাওয়ার উল্লেখও হাদীসে দেখিতে পাওয়া যায়। এহরামের পোশাক পরিহিত থাকার কারণেই সে অবস্থায় পবিত্র বগল দেখা গিয়েছিল। আলীর (আ.) দুই বাহু ধরার দৃশ্যটি এমন হইয়াছিল যেন তিনি ছোট্ট একটি শিশুকে ধরিয়া জনগণের দিকে তাহাকে শূণ্য এ তুলিয়া দুই হাত উর্ধ্বে উঠাইয়া ধরিলেন।

মেশকাত হাদিস গ্রন্থে গাদিরে খুমের হাদিসটি এইরূপে বর্ণিত আছে:-

বারায়া ইবনে আজেবাজে এবং জায়েদ ইকব আকরাম বর্ণনা করিয়াছেন: যখন রাসুলুল্লাহ (আ.) গাদিরে খুমে আসিয়া অবতরণ করিলেন, আলীর (আ.) হাত ধরিলেন এবং বলিলেন: তোমরা কি জাননা যে, আমি মোমিনদিগের নিজদিগ হইতে অধিক আওলা? লোকেরা বলিল: হ্যাঁ। তখন তিনি বলিলেন: তোমরা কি জাননা যে, আমি প্রত্যেক মোমিনের নিজের প্রাণ হইতে আওলা? লোকেরা বলিল: হ্যাঁ। তখন তিনি বলিলেন: হে আল্লাহ, আমি যাহার মাওলা আলীও তাহার মাওলা। হে আল্লাহ, যে ব্যক্তি তাহাকে বন্ধু বানায় তুমিও তাহাকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করিও এবং যে তাহার সঙ্গে শত্রুতা করে তুমিও তাহার সঙ্গে শত্রুতা কর। অতএব ইহার পর (অর্থাৎ রাসুলের ভাষণের পর) ওমর (রা.) তাঁহার (মাওলা আলী আ.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন এবং তাহার অভিনন্দনে তাঁহাকে বলিলেন: হে আবু তালেব সন্তান, প্রত্যেক মোমিন নরানারীর মাওলা (আমিরুল মোমিনুন)  হিশেবে অভিনন্দিত হইয়া তুমি সকাল করিবে এবং সন্ধ্যা করিবে। (আহাম্মদ) আল হাদীস (মেশকাত) চতুর্থ খণ্ড, ৫৪৮ পৃ. ফজলুল করিম।

“ইয়াওমাল খামিস”

‘ইয়াওমাল খামিস’ অর্থ বৃহস্পতিবার। সেইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাসুল (সাঃ) অত্যন্ত অসুস্থ। তিনি বলিলেন; কাগজ কলম আন, আমি অসিয়ত লিখিয়া দিয়া যাই, যাহা অনুসরন করিলে তোমরা আর কখনও বিভ্রান্ত হইবে না। তাঁহার (সাঃ) ‘আহলে বাইত’ অর্থাৎ ‘ঘরের লোকেরা’ ঐ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহন করিয়া ঘরেই রহিলেন ( অর্থাৎ সত্যের ঘএ রহিলেন ) এবং নবুয়তের ঘরের শান এবং উহার দান সামলাইয়া লইলেন তাঁহাদের মধ্যে। আর বাহিরের লোকেরা মোর্চা সংগঠনে ব্যাস্ত হইয়া পড়িল; গঠন করিল বাহিরের শক্তির বিরাট দুর্গ।

এইরূপ বিজয়ী নবীর দানের বাহ্যিক অংশ লইয়া একদল শক্তিমদে মত্ত হইয়া উঠিল। অপর দল (অর্থাৎ আহলে বাইতগণ) নবী কে তাঁহাদের মধ্যে রাখিয়া তাঁহার দাফন-কাফনে শরিক হইয়া নবীর নবুয়্যতের শানকে তাঁহাদের আওতার মধ্যে সমাহিত করিয়া আধ্যাত্বিক বিজয়ের রওজা মোনাওয়ারা তৈরী করিয়া তুলিলেন। নবী ঠোঁট নাড়িয় “রাব্বি হাবলি উম্মাতি, রাব্বি হাবলি উম্মাতি” (হাবলি অর্থ-আমাকে দান করুন) বলিতে বলিতে পরপারে (আলোর দেশে) চলিয়া গেলেন।

“হে আমার রব আমার উম্মত আমাকে দাও, আমার উম্মত আমাকে দাও-” এইভাবে তিনি তাঁহার উম্মতের সঙ্গি হইয়াই রহিলেন। শেষ নিঃশ্বাসে যে যাহা চায় সে তাহাই পায়, বিশেষ করিয়া ইহা হইল নবীর চাহিদা। ‘উম্মতি’ বলিতে সবাইকে মনে করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে, দলের বেশিরভাগ লোক হইতে হতাশাগ্রস্থ নবী গুটিকতক আপনজনকে স্বভাবতই আঁকড়াইয়া ধরিবার আকুল আবেদন প্রকাশ করিয়া উঠিলেন ‘ হাবলি উম্মতি ‘ বলিয়া। যাঁহারা ‘ আমার উম্মত ‘ এইদলে রহিলেন তাঁহারাই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ অংশ পাইলেন। তাঁহারা আহলে বাইত দলের সমর্থক দল হইয়া রহিলেন। আর যাহারা বাহিরে রহিল, শক্তি সঞ্চয় করিল, তাহার সংখ্যাধিক্য অর্জন করিল, প্রাচুর্য আনয়ন করিল।

ফাতহাম মোবিন‘ এর অধিকারী অর্থাৎ জাহেরে বাতেনে স্পষ্ট বিজয়ী, সর্বশ্রেস্ট মুজাহেদ, বিজয় সম্রাট রাসুলের (সাঃ) রাব্বিল আল আমিন আপন গৃহে পর্দার অন্তরালে যাত্রা করিতেছেন । বাহিরের লীলা সংবরণ করিয়া এককভাবে মোমিনের অন্তরে লীলায়িত হইয়া উঠিবার জন্য আলোকরূপে আহলে বাইতের অন্তর রাজ্যে প্রবেশ করিতেছেন। যাহারা তাহাকেই চাহিল, তাহারা অন্তরে নবীর আদর্শের বুনিয়াদ শক্ত করিল। বাহিরের হুমকি অগ্রাহ্য করিল। বাহিরের বিজয় কে যাহারা গ্রহন করিল তাহারা তাহার বিজিত রাজ্য সুখভোগের দিকে ছুটিল।

উপস্থিত প্রেমিকগণ তাহাদের সংসার ভুলিলেন। দেহে থাকিয়াও’বিদেহী নবীর সঙ্গে তাহারাও যেন বিদেহী হইয়া গেলেন। স্তব্ধ এবং হতভম্ব হইয়া আত্মবিস্মৃত অবস্থায় তাহারাও যেন কোন অজানা কল্পলোকে যাত্রা করিলেন তাহা তাহারা নিজেরাই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না, ইহা তাহাদের কি হইলো? প্রেমের অভিনয় যাহারা করিতে পারে তাহারা অভনয় করিল। মরমে যাহারা মরিতে জানে তাহারা জীবন্মৃত হইল। কাহার সাধ্য তাহাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয় বাহিরের লাভ লোকসান ? ভাবুক ভাবিতে পারে না, কথক কহিতে পারে না, কী সেই রূপ? কোথা তাহার গতি? আহলে বাইতগণ তাঁহাদের দেহের গৃহে নাই। কোথায় যেন হারাইয়া গিয়াছেন।

যাহারা ওজন করিয়া প্রেম করে তাঁহাদের কথা আলাদা । প্রেমাস্পদের বিয়োগান্তেও তাহারা বুদ্ধি করিয়া সব কিছু বিবেচনা করিয়া অনেক কথাই ভাবিতে পারে। এখান হইতে সাহাবিগণ দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া যাওয়ার সূত্রপাত হইয়া গেল । একভাগ উম্মতে মোহাম্মদি সাহাবি, অপরভাগ কলেমা পাঠকারী সাহাবি! পরবর্তীকালে উদ্ভুত এই দুইটি দলের পরস্পরবিরোধ এবং আদর্শগত এই পার্থক্য সর্বপ্রথম নির্ণয় করিয়া দিল হাদিসে কেরতাসে উল্লিখিত এই বিশিষ্ট ঘটনা। অর্থাৎ ‘ বেরিয়ে যাও ‘ ঘটনা।

হিজরি সন প্রবর্তনের ইতিবৃত্ত

সেইদিন ছিল মক্কাবাসির বিজয় উৎসব দিবস। তাহাদের ধর্মের প্রধান শত্রুদল এবং মক্কার প্রধান শাসক আবু তালেবের (আঃ) বংশধরগণ নির্যাতিত হয়ে পরাজয় বরণ করিয়এ পালাইয়া গিয়াছে। সেইদিন ঘরে ঘরে আনন্দের রল পড়িয়া গিয়াছিল। মদ্যপান ও নাচগানের আসরের ধুম চলিয়াছিল। দেব-দেবীগণের প্রতি ভক্তি ও পূজা-অর্চনা দেওয়া হইয়াছিল, যেহেতু তাহাদের দুশমন মোহাম্মদ আ. দলবল লইয়া পালাইয়া গিয়াছেন।

তাঁহার আবু তালেবের (আঃ) এন্তেকালের পর হইতে রাসুল (আ.) জীবনের বিষাদময় এবং ঘোর বিপদময় দুইটি বছর অতি কষ্টে অতিবাহিত হইয়াছিল। তাঁহার দুর্দশার যে চরম পরিণতি মক্কায় ঘতিয়াছিল তাহারই বিষাদময় স্মৃতি দিবস “হিজরত” হইল আনন্দে উৎফুল্ল মক্কানগরী।

খলিফা হযরত ওমর  যখন খলীফা পারস্য ও মিশর জয় করিয়াছেন এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন তখন তিনি বলিলেনঃ “বিশ্বের সকল বৃহৎ জাতিসমূহের নিজস্ব একটি সাল এবং বর্ষপঞ্জিকা থাকে আমাদেরও একটি সাল থাকা প্রয়োজন”।

কখন হইতে কোন ঘটনাকে স্মরণীয় করিয়া এই সাল আরম্ভ হওয়া উচিত তাহার উপর আলোচনা হইল। যে কয়টি বিশেষ ঘটনার প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছিল তাহা হইলঃ
১) রাসূল পাক (সাঃ) এর এন্তেকাল দিবস। যেমনঃ ঈসা (আঃ) এন্তেকাল দিবস হইতে খ্রিষ্টাব্দ গণনা আরম্ভ করা হইয়াছে।

২) রাসূল পাক (সাঃ) এর জন্মদিবস।

৩) প্রকাশ্যে সমাজের নিকট প্রথম নবুয়ত প্রকাশ দিবস। যাহাকে ‘এলানে নবুয়ত’ বলা হয়।

৪) ইসলামের/দ্বীনে মোহাম্মদীর প্রথম বিজয় বদর যুদ্ধের বিজয়।

৫) রাসূল পাক (সাঃ) এর মক্কা বিজয় দিবস। যেহেতু মক্কা ছিল বৃহত্তর শত্রুদেশ এবং বৃহত্তর বাঁধা। ইহার  পতনে দ্বীনে মোহাম্মদীর চরম বিজয়ের সূচনা করিয়া দিল।

৬) রাসূল পাক (সাঃ) কে মারিয়া ফেলিতে না পারিলেও তিনি মক্কাতে ধর্মপ্রচারের পরাজয় গ্রহণ করিয়া প্রাণ লইয়া কোনমতে ভাগিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন, সেই বিজয় উৎসবের হিজরত দিবস।

এই ছয়টির প্রস্তাবের মধ্যে হিজরত দিবসই স্মরণীয় করিয়ার রাখার প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন খলিফা ওমর (রা:)। হিজরি সাল গ্রহণের পেছনে তাহাদের অন্তরে কি যুক্তি ছিল? রাসুলাল্লাহ (আ.) মক্কা জয় করিয়াছিলেন। মক্কাবাসীগণ বাধ্য হইয়া অবস্থায় চাপে পড়িয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। মক্কাবাসীগণ বাধ্য হইয়া অবস্থার চাপে পড়িয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিল বিজয়ী দলের নিকট। আসলে ধর্ম তাহারা গ্রহণ করে নাই বলিলেই চলে। প্রকাশ্য মূর্তি পুজা বাদ দিয়াছিল মাত্র। তাহারা সুযোগ গ্রহণ করা হইল। খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হইল। বিজয়ী দলকে বিজিত করা হইল। তাহাদের মতে রাসুলাল্লাহ আ. ধর্মের নামে আসলে তাঁহার বংশধরের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহার সেই উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করিয়া দিতে পারিয়াছিল খেলাফত। সেইজন্য এই বিজয় দিবস “হিজরত”

মক্কা বিজয় দিবসকে স্মরণীয় দিবস হিসাবে মোটেই গ্রহণ করা যাইতে পারে না। উহা গ্রহণ করিলে শুধু রাসুলের (আ.) জয় নহে, মক্কার উপর মদিনার জয়ও সুচিত হয়। কোরেশদের উপর আনসারগণের বিজয় স্মৃতি? সে তো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। খেলাফতের বিরুদ্ধে বিশ্বের মুসলমান এই জাতীয় হোক কথা কোনকালেই বরদাস্ত করিতে রাজী থাকে নাই। এইজন্যই সমগ্র মোসলেম শাসন আমলে, তাহার সকল যুগেই অসংখ্য অন্যায় এবং অত্যাচার সংঘটিত হইয়া গিয়াছে।

বর্তমান যুগের মোসলেম দেশগুলি কতকটা ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্যেও প্রাচীন মতবাদ এখনও অটুট রহিয়াছে। এইতো সেদিনের কথাঃ মিশরের প্রধান বিচারক (Chief Justice) ডক্টর আলী আব্দুর রাজ্জাক একখানা বই লিখিয়াছিলেন, তার নাম “আল ইসলাম ওয়া অসুলুল্‌ হাকাম” অর্থাৎ “ইসলাম এবং হুকুমতের মূল ভিত্তি।” তাহার এই পুস্তকে তিনি এই কথাই প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, ইসলাম ধর্মের মূলনীতি যাহা রাসুলাল্লাহ আ. নির্দেশ দান করিয়া গিয়াছেন আর যে সকল শাসনমূলক মূলনীতি যুগে যুগে তথাকথিত মোসলেম রাষ্ট্র গ্রহণ করিয়া আসিতেছে তাহা মোটেই এক নয়।

অর্থাৎ রাসুলের (আ.) প্রকাশিত ব্যবস্থার সঙ্গে কোন শাসন ব্যবস্থার মূলনীতির কোন মিল ছিল না। খেলাফত হইতে এই ব্যতিক্রম আরম্ভ হইয়াছিল। এই সত্য কথা প্রকাশের ফলে তাহার বইখানা বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁহাকে চাকুরী বরখাস্ত করিয়া দেওয়া হয়। রাষ্ট্র বর্তমান যুগে ধর্মনিরপেক্ষ, তাই প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করা হয় নাই।

লোক পরম্পরায় কথিত দুইটি ঘটনা 

(১) গাদিরে খুম হইয়া মদিনা প্রত্যাবর্তনের পথে হারেস ইবনে নোমানে ফাহরী নামে এক ব্যক্তি রাসুলাল্লাহর (আ.) নিকটে আসিয়া বলিল, “হে মোহাম্মদ, সালাত, সওম ইত্যাদির জন্য যাহা বলিয়াছিলে তাহা মানিয়া লইয়াছিলাম। আজ অবশেষে তুমি যে স্বগোত্রীয় আলীকে বিশ্বাসীগণের মাওলা ঘোষণা করিয়াছে, ইহা কি নিজের ইচ্ছায় করিয়াছ, না আল্লাহর আদেশে করিয়াছ?” রাসুলাল্লাহ আ. বলিলেন, আল্লাহর আদেশেই ঘোষণা করিয়াছি। ইহা শুনিয়া প্রশ্নকারী বলিল: “আল্লাহর নির্দেশেই যদি ঘোষণা করিয়া থাক তবে (তার প্রমাণ স্বরূপে) আমার উপর বজ্রপাত হউক।” ইহা বলিবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার ঘোড়া হঠাৎ ভড়কাইয়া ছুট দিল এবং সহসা বজ্রঘাতে লোকটির মৃত্যু ঘটিল। লোকটির বক্তব্য এইরূপেও শ্রুত হইয়া থাকে:- “আল্লাহুম্মা ইন কানা হাজা হুয়াল হাক ফামাতির আলাইয়া হেজারাতাম মিনাস সামা”। অর্থ :হে আল্লাহ যদি ইহা সত্য হইয়া থাকে তাহা হইলে আমার উপরে আকাশ হইতে প্রস্তর বর্ষিত হউক। তাহার প্রার্থনা অনুযায়ী তত্ক্ষণাত্ তাহাই ঘটিল। ঘটানাটি লোকের মুখে মুখে কথিত হইয়া আসিতেছে।

(২) হযরত ওমর (রা.) মদিনায় যাইয়া রাসুলাল্লাহকে (আ.) বলিলেন- আমি যখন আলীকে (আ.) মোবারকবাদ দিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইলাম, একজন সুপুরুষ যুবক আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, যাহাকে আমি আর কখনো দেখি নাই: তুমি কি আলী কে মোবারকবাদ দিয়াছিল? “উত্তরে আমি বলেছিলাম: আমি কেন দেব না?” সে বলিল: “তুমি যে মোবারকবাদ দিয়াছ তাহা কখনো ভুলিও না!” এই বলিয়া সে চলিয়া গেল। আর কাহাকেও জিজ্ঞাসাবাদ না করিয়া আমাকে কেন বলিল? উত্তরে রাসুলাল্লাহ আ. বলিলেন: “তোমা হইতে কোন খাতরা হইতে পারে সেইজন্যই বলিয়াছিল। “

মাওলাইয়াত দিবস পালন উপলক্ষে (ইয়াওমাল গাদির)

Declaration of “Mawlaiyat ” i.e -Overlordship

বিশ্বাসীর জন্য “এলানে নবুয়ত” যেমন একটি স্মরণীয় এবং পালনীয় দিবস তেমনই “এলানে মাওলাইয়াত” একটি বিশেষ পালনীয় দিবস। বিশ্বাসীর উদ্ধারের জন্য জ্ঞানের এই দরজার ভিক্ষা বা বকশিশ পাইতেই হইবে, নতুবা জাহান্নাম হইতে উত্তোরণ উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সম্ভবপর নয়। “মাওলাইয়াত” -এর জাহের রাসুলে খোদার জাহেরী অবর্তমানে তাঁহারই জায়গায় সকল কাজের জাহেরী এন্তেজাম দেওয়ার জন্য আলীকে (আ.) “মাওলা ” অর্থাৎ নেতৃত্ব দান করিবার জন্য অধিস্বামী বা প্রতিনিধি বানাইয়া গেলেন।

স্বভাবে জড়বাদের দিকে যাহাদের প্রবণতা বেশী তাহাদের জন্য রাসুলের (আ.) দৈহিক অবর্তমানে রাসুলাল্লাহর (আ.) স্থলে বিশ্বাসীগণের নেতৃত্ব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য আল্লাহতায়ালা র নির্দেশে রাসুল পাক (আ.) ১৮-ই জিলহজ তারিখে খুম নামক স্থানে জলাশয়ের (গাদির) সন্নিকটে সাহাবীগণের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেন আলী শেরে খোদার “মাওলাইয়াত ” বা রাসুলের (আ.) স্থলাভিষিক্ত নেতৃত্ব। ইহাই হইল সাধারণভাবে সর্বসাধারণের জন্য গাদিরে খুমের ঘটনা

ঈদে গাদির

মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ “ঈদ দিবস ” অর্থাৎ “আনন্দ দিবস ” হইল গাদিরের অভিষেক দিবস। রাসুল আ. তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বুনিয়াদ উম্মতগণকে দান করিয়া গেলেন। আল্লাহর সমগ্র জ্ঞানের অধিকারী রাসুলাল্লাহ আ. তাঁহার জ্ঞানের দ্বার খোলা রাখিয়া গেলেন। মৃত্যুর পরশ লাগিয়া উহা অন্তর্ধান হইল না। যাহাতে সাধারণ মানুষও সেই দ্বার হইতে জীবন দর্শন এবং জ্ঞান আহরণ করিতে পারে সেই ব্যবস্থাই তিনি করিয়া গেলেন যোগ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়া।

ইরানে ইহাকে “নওরোজ ” বলা হয়, কারণ নবী অন্তরালে চলিয়া গেলেও জ্ঞানের নব দিগন্ত উন্মোচনের সকল এন্তেজাম মওজুদ রহিল। ইহা রাসুলাল্লাহ আ. তাঁর জ্ঞানরাজ্যের “প্রবেশ দ্বার “এর উদঘাটন দিবস। অতএব ইহা পরবর্তী সমগ্র মানবজাতির জন্য নবুয়তের জ্ঞান লাভের পথে দ্বার উদঘাটন দিবস। স্বর্গীয় জ্ঞান আহরণ ইচ্ছুক প্রতিটি মানবের জন্য ইহা একটি আশীর্বাদ।

রাসুলাল্লাহ আ. আল্লাহর সমগ্র জ্ঞানের অধিকারী। সমগ্র জ্ঞানের কোন একদিকেও যদি তিনি অসম্পূর্ণ থাকেন তাহা হইলে সেই বিষয়ে কোন প্রশ্ন যদি কেহ করে এবং নবী যদি উত্তরে বলেন :”আমি ইহা জানি না ” তাহা হইলে তিনি আল্লাহর রাসুল হইতে পারেন না। এইজন্য দেখিতে পাই নবী আ. জ্ঞানের যিনি দ্বার তিনিও বলিয়াছেন, “যাহা কিছু জানিতে চাও আমি বাঁচিয়া থাকিতে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতে পার “(হাদিস)। এদিক হইতে বিচার করিলেও দেখা যায় মানুষের নিকট জ্ঞানের ভাণ্ডার আগমনের মহান আনন্দ দিবস ঈদে গাদির হইল অতুলনীয়।

রাসুলাল্লাহ আ. বলিয়াছেন : গাদিরে খুম দিবস আমার উম্মতের সকল ঈদ দিবস হইতে উত্তম। এবং উহা সেইদিন যেদিন আল্লাহতায়ালা আমাকে তাঁর (সঙ্গে) সংযোগের নির্দেশ দিলেন আমার ভাই আলী ইবনে আবু তালেবের বংশধরের সহিত- যাহাতে (তাহার) আমার পরে জ্ঞান দান করিতেছে পারেন আমার উম্মতের হেদায়েত লাভের জন্য। এবং উহা সেইদিন যেদিন আল্লাহ আদদ্বীনকে পরিপূর্ণ করিলেন। এবং তাহাদের (অর্থাৎ উপস্থিত উম্মতদের) আত্মসমর্পণের দ্বীনের উপায় আল্লাহ রাজি হইলেন। (“সৈয়দ ইবনে হাসান নফজী “এর লিখিত “গাদিরে খুম” নামক উর্দু পুস্তিকা হইতে উদ্ধৃত। ইহা ফারাত ইবনে ইব্রাহীম কুফির তফসির হইতে তিনি গ্রহণ করিয়াছেন)

ব্যাখ্যা:- এই হাদীসে রাসুলাল্লাহ আ. ঘোষণা করিতেছেন যে, উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য যত রকমের আনন্দ দিবস রহিয়াছে তাহার মধ্যেই সর্বোত্তম আনন্দ দিবস হইল খুম দিবস। এর কারণ খুম দিবস এমন একটি দিবস, যেদিন আল্লাহতায়ালা রাসুলকে (আ.)নির্দেশ দিলেন যেন রাসুলাল্লাহ আ. তাঁহার ভাই আলীর (আ.) বংশধরের সঙ্গে আল্লাহর সংযোগ লাগাইয়া দেন। নবী বিদায় গ্রহণ করিতেছেন, তাই নবীর অবর্তমানে উম্মতগণের হেদায়েতের জন্য আল্লাহতায়ালা তাঁহার নবীকে নূরে মোহাম্মদীর ধারক এবং বাহক প্রতিনিধি তৈরি করিয়া জাহেরে বাতেনে তাহাদিগকে সেই নূরের অধিকারী করিয়া দেওয়ার নির্দেশ দিতেছেন এবং তাহা দ্বারা তাহাদিগকে আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত করিয়া দিতে বলিতেছেন।

নবী বর্তমান থাকতে উম্মতকে জ্ঞানদান করিবার অধিকার কাহারও নাই। তাই তাঁহার জাহেরী অবর্তমানে তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি তৈরি করিয়া উম্মতগণকে জ্ঞানদান করিবার অধিকার আলী আ. ও তাঁহার বংশধরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে (এই দিনে) অর্পণ করা হইল। কেহ হয়ত বলিবেন আলী আ. সঙ্গে তাঁর বংশধরের কাহারও অভিষেক সেদিন হয় নাই। তাহা হইলে এই হাদীসে বংশধরের কথা উল্লেখিত হয় কেমন করিয়া? এই অভিষেক দ্বারা আলীর (আ.) বংশ হইতে একের পর একজন করিয়া নবীর নায়েব নিয়োগ করিবার অধিকার দেওয়া হইল।

আল্লাহর দড়ি (হাবলুল্লাহ) প্রলম্বিত করিয়া দেওয়া হইল একের পর একজন করিয়া নায়েবে নবী নিয়োগ করিবার অধিকার দানের মাধ্যমে। এইসব নিয়োগ আল্লাহ এবং তাঁহার রাসুলের (আ.) ইচ্ছাক্রমেই একের পর এক হইতে থাকিল। নবী তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে জাহেরীভাবে বিদ্যমান থাকিলেন। কিন্তু বার জনের পর আল্লাহর এই দড়ি মানুষের অবাধ্যতার জন্য ছিন্ন হইয়া গেল।

খুম দিবসে উম্মতে মোহাম্মদীর দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করিল, কারণ মোহাম্মদী দ্বীন আলোর দ্বার তথা জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দেওয়া হইল। নবীর এন্তেকালের দ্বারা উহার সমাপ্তি ঘটিল না। ফলত :রাসুলের (আ.) উম্মতের উপর আল্লাহর দেয়া নেয়ামত পূর্ণতা প্রাপ্ত হইল। আল্লাহতায়ালা খুমে উপস্থিত ব্যক্তিগণের দ্বীনের উপর সন্তুষ্ট হইলেন —যাহারা সত্যিকার আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। অর্থাৎ আত্মসমর্পনের দ্বীনকে যাহারা খুম দিবসে আনুগত্যের দ্বারা গ্রহণ করিল তাহাদের উপায় আল্লাহ রাজি হইলেন। (মাওলার অভিষেক: সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী)

যেকারণে কারণে খেলাফতের বিরুদ্ধে মাওলা আলী (আঃ) অস্ত্র ধারণ করেন নাই!

ধর্ম জোর জবরদস্তির বিষয় নয়। ইহা মনের ব্যাপার। আল্লাহ এবং তাঁহার রাসুল ইচ্ছা করিলেই সকল লোকদিগকে ধর্ম বিশ্বাসী বানাইতে পারেন না। মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করিবার পর আল্লাহ ইচ্ছা করিলেই কোন লোককে হেদায়েত দান করিতে পারেন না, যদি সে উহা গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক না হয়। বিশ্বাস করিয়া নবীর নির্দেশিত পথে চলিতে চাহিলে মানুষকে হেদায়েত দানা করা আল্লাহ এবং রাসুলের কাজ। নবীদের অমান্য করা মানুষের সাধারণ স্বভাব। নবী আ. ইচ্ছা করিলে অবশ্য পাথরের জবাব পাথরের দ্বারা দিতে পারিতেন। যেমনঃ বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি নানারূপে নৈসর্গিক বিপর্যয় আনিয়াও মানুষকে শাস্তি দিতে পারিতেন এবং আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে তাহা দিয়াও আসিয়াছেন। উহা দ্বারা পাপীর শাস্তি হইতে পারে কিন্তু হেদায়েত হয় না।

আলী আ. নবীর আ. প্রকৃত অনুসারী। তাই তিনিও নবীর (আ.) মতই অন্যায় অবিচার এবং ধর্ম বিরোধিতা বরদাস্ত করিয়া গেলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থে কাহারও উপর হাত উঠাইলেন না। তাঁহার গলায় দড়ি দিয়া তাঁহাকে খলিফার নিকট আনা হইয়াছিল। ইহার প্রতিবাদে তিনি ইসলামকে রক্ষা করার খাতিরেই জুলফিকার চালনা করেন নাই। জনগণের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া তাহাদিগকে সত্য ধর্মে দীক্ষিত করিয়া লইবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকিলেন। ইহার ফলে বহু লোক পরবর্তীকালে তাঁহার আদর্শের সমর্থক হইলেন বটে বিরাট জনতার তুলনায় তাহাও ছিল অতি নগন্য। অন্যায়ের সমর্থকগণই বিপুল পরিমাণে সংখ্যাধিক রহিয়াই গেল।

এইজন্যই সত্য আর কখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জয়ী হইয়া উঠিতে পারিল না। মাওলা আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণ করিলেন এবং তাঁহার বংশধরগণ কারবালায় প্রায় শেষ হইয়া গেলেন। কারবালায় সত্যের সমাধি রচিত হইল। হোসাইন আ. কারবালায় শিক্ষামূলক যে আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিয়া গেলেন তাহার সঠিক মর্যাদা মুসলমানগণ কোনকালেই আর দিতে পারে নাই। (মাওলার অভিষেক: সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী)

গাদিরে খুমের আরো কিছু পোস্ট লিংক  নিম্নে দেওয়া হলো:

* গাদিরে খুম এর ঐতিহাসিক ভাষণ ও স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা
* আমিরুল মোমেনিন মাওলা আলী (আ:) এর খুতবা:
* গাদিরে খুম এর ঐতিহাসিক ভাষণ ও স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা