খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহঃ) এর ১২০টি বাণী ও উপদেশ।
হযরত খাজা ইউনুস আলী: হযরত খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ.)’র জন্ম ১৮৮৬ সালে, শনিবার সুবহে সাদিকের সময়। পিতার দিক দিয়ে ফাতেমী বংশের এবং মায়ের দিক দিয়ে খলিফা হজরত আবু বকর (রাদ্বি.)’র বংশের সাথে সম্পৃক্ত। পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃবিয়োগ হওয়ায় মহীয়সী ও বিদূষী মাতার তত্ত্বাবধানে অপ্রাতিষ্ঠাতিকভাবে পৈতৃক পাঠাগারে সংরক্ষিত কুরআন—হাদিস—ফেকাহ ও অন্যান্য কিতাবাদি অধ্যায়নসহ আরবী ও ফারসি ভাষার বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। বিংশ শতাব্দীর এ মহান আধ্যাত্মিক রাহবার হযরত খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ.) ২রা মার্চ ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ ১৮ই ফাল্গুন, ৫ই জমাদিউস সানী ১৩৬৮ হিজরীর রোজ রবিবার বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে ৬৪ বছর বয়সে অসংখ্য তরিকত অনুসন্ধানী ও দ্বীনের দাঈয়ী রেখে চিরদিনের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।
(১) ক্বলবকে তাজা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ কর। যাতে কবর জীবন সুন্দর হয়।
(২) যথাসময়ে সালাত আদায় কর।
(৩) শেষরাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর গুণাবাচক নাম ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাহমানু ও ইয়া রাহিমু বলে আল্লাহ কে ডাকা এবং আল্লাহর কাছে সবসময় ক্ষমাপ্রার্থনা করা। এতে নিহিত রয়েছে দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
(৪) মুখে, মনে ও বিশ্বাসে আল্লাহকে এক বলে স্বীকার কর।
(৫) শ্বাসপ্রশ্বাসে আল্লাহকে স্মরণ কর ও অন্তরে সবসময় আল্লাহর মুহাব্বত রাখ।
(৬) কাউকে হিংসা না করা। কারণ হিংসা করা জীবজন্তুর কাজ।
(৭) চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, হারামী না করা। মিথ্যা না বলা। পরনিন্দা ও পরচর্চা না করা। কারো অনিষ্টা না করা এবং কাউকে অভিসম্পাত না করা। নিন্দা সহ্য করা। হারাম না খাওয়া। নাপাক কাজ ও লোক দেখানো পোশাক পরিধান না করা। হালালভাবে আয়—রোজগার করা। অল্প আহার ও অল্প নিন্দ্রা ও অল্প কথার অভ্যাস করা। আইন ভঙ্গ না করা। শরীয়তের হুকুম—আহকাম মেনে চলা।
(৮) আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের রূহ পাকে সওয়া রেছানির সময় শোরগোল বা বেয়াদবি না করা।
(৯) প্রকৃত আউলিয়াদের আখলাক ও পদাঙ্গ অনুসরণ কর।
(১০) হুজুরী ক্বলবে নামাজ আদায় করা তথা নামাজ অবস্থায় দিল কে আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জুহ রাখ। কারণ নামাজে আল্লাহর স্মরণে বিচ্যুতি ঘটলে বান্দা আল্লাহর দরবারে মহাপাপী হিসেবে গণ্য হবে।
(১১) দিনে কম আহার কর। কারণ পেটভরে খাবার খাওয়া চতুষ্পদ জন্তু বৈশিষ্ট্য।
(১২) শরীয়ত বর্জন করে তরীক্বত চর্চা না করা। শরীয়ত পালনের মাধ্যমেই তরীক্বত, হাকিক্বত ও মারেফত লাভ করা যায়।
(১৩) রাসূল্লাল্লাহ দ.’র মুহাব্বত মুমিন ও মুসলমাদের ঈমান। রাসূল্লাল্লাহ দ.’র প্রতি যার যতটুকু মুহাব্বত তাঁর ঈমানও ততটুক এবং সবসময় সুন্নতি তরীক্বায় জীবনযাপন ও চলাফেরা কর।
(১৪) পশু—পাখি ও জীবজন্তুকে ঘৃণা না করা। কারণ তাঁরা সবসময় আল্লাহর জিকিরে রত থাকে।
(১৫) নিজকে ভাল না জানা। কারণ যে নিজকে ছোট জানে সে আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হয়।
(১৬) ধমীর্য় সম্প্রীতি বজায় রাখা।
(১৭) কুরআন আল্লাহর প্রকৃত কালাম এবং তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল আল্লাহর খাস কালাম।
(১৮) শরিয়ত, তরীক্বত, মারেফত ও হাকিক্বতের পূর্ণ আমল করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়।
(১৯) প্রতিটি নিঃশ্বাসেই আল্লাহর স্মরণ ক্বলবে জারি রাখো। কারণ মৃত্যুর সময় ক্বলব জারি না থাকলে অথার্ৎ ক্বলবে আল্লাহর জিকির না থাকলে বেঈমান হয়ে মরার সম্ভাবনা বেশি।
(২০) হালাল ব্যবসা করো, হালাল খাও এতে অপমান নেই। হারাম কাজে বেজ্জুতি আছে।
(২১) সূফিদের ক্বলব বা আত্মা আল্লাহর জিকিরে জিন্দা থাকে। আর নফস বা কুপ্রত্তি মৃত থাকে।
(২২) মারেফতের এলম হাসিল হলে সবসময় আল্লাহর ফয়েজ ও তাজাল্লি বান্দার উপর বর্ষিত হয়।
(২৩) প্রকাশ্যে শরীয়ত মোতাবেক চলো এবং অপ্রকাশ্যে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল দ.’র প্রেমে বা এশকের আগুনে নিজকে জ্বালাও।
(২৪) সত্য কথা ও হালাল খাদ্য তরীক্বতের মূল।
(২৫) জীবন ক্ষণস্থায়ী কর্তব্য বহু অথার্ৎ আয়ু অল্প, কাজ বেশি।
(২৬) অনর্থক কথা ও কাজ এবং তর্কাতর্কি হতে বিরত থাকা।
(২৭) আল্লাহকে চেনার পথে দুঃখ আছে।
(২৮) আমরা রাসূল পাক দ.’র উম্মত এ বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকা দরকার।
(২৯) কোন পীর—আউলিয়া তথা আল্লাহর সৃষ্টিকে সেজদা না করা। গায়ের জোরে কেউ এ কাজ করলে সে কাফের ও শয়তান হিসেবে বিবেচিত হবে।
(৩০) আল্লাহর অলিদের মজলিস বা আল্লাহর অলিদের সাথে বিয়াদবি করো না। এমনকি ধমীর্য় অনুষ্ঠানেও। কারণ বেয়াদবি করলে তদকীরে পোকা ধরবে এবং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবে। ফয়েজ বন্ধ হয়ে যাবে। বিপদ নিয়ে বাড়ী ফিরতে হবে।
(৩১) আল্লাহর অলিদের মজলিশে বা দরবারে জবান বন্ধ রাখা; চিল্লাচিল্লী না করা। বিপরীত করলে নিজের ক্ষতি হবে।
(৩২) আমার নাম বা তরীক্বার নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ টাকা—পয়সা চায়লে বুঝবে সে আমার মুরিদ না। কারণ আল্লাহ ব্যতিত জীবনে কারো কাছ থেকে কিছু চায়নি।
(৩৩) কামেল আল্লাহ ওয়ালা বান্দাদের কাছ থেকে লা—ইলাহা—ইল্লাল্লাহু জিকির অন্তরে দাগ করে নাও কারণ এ কালিমা সবসময় জিকির করা অভ্যাস করলে সিনা উজ্জ্বল হবে। আল্লাহর অলিরা বান্দার সিনায় কালিমা দাগ করে দিলে সে দাগ মুছে যায় না। তবে কর্মদোষের কারণে এ দাগ মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
(৩৪) বাসনাকে সংযত কর তবেই নফসের উপর জয়লাভ করতে পারবে।
(৩৫) কামেল সূফীদের সঙ্গে থাকা উচিৎ। যে সূফীগণের সঙ্গ ভালবাসেনা তার হৃদয়ে রোগ আছে।
(৩৬) জীবে সেবা করলে পক্ষান্তরে আল্লাহকে সেবা করা হয়। জীবে দয়া করলে আল্লাহও তাকে দয়া করে থাকেন।
(৩৭) আশেক এবং ধার্মিক এক কথা নয়। সব ধার্মিক সব সময়ে আশেক নাও হতে পারে। খাঁটি প্রেমিক প্রেমের মধ্যকার কন্টকাকীর্ণ পথ দেখে ভীত হন না।
(৩৮) যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক রসনায় কথা বলেন ও আধ্যাত্মিক কর্ণে আল্লাহ হতে তত্ত্ব অবগত হন, তাঁর বাহ্যিক রসনা ও কর্ণ বোবা ও বধির।
(৩৯) যে পর্যন্ত মানব দুনিয়ার টাকা পয়সা এবং স্ত্রী—পুত্রের চেয়ে আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বত অধিক না হাসিল করে, সে পর্যন্ত খাঁটি মুমিন হয় না।
(৪০) আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব, আল্লাহর জন্য শত্রুতা ও আল্লাহর জন্য প্রেম কর। আল্লাহর প্রতি প্রেম এবং আল্লাহর মারেফাত হাসিল হলে লোক সমাজে জীবন যাপন করতে হৃদয় সংকুচিত হয়ে থাকে।
(৪১) নিত্য জিনিসের সহিত প্রেম করলে অনিত্য বস্তু তার শত্রু হয়ে থাকে। যিনি আপন হৃদয় আল্লাহকে উৎসর্গ করেছেন এবং তাঁর সেবাতে দেহ নিযুক্ত রেখেছেন, তিনি তত্ত্বজ্ঞ।
(৪২) হৃদয়ের অনুভূতিতে আল্লাহর তত্ত্ব জ্ঞান প্রকাশ পায়। আল্লাহ যে সাধকের আত্মা জ্যোতিতে সঞ্জীবিত করেন, তার আর কখনো মৃত্যু হয় না।
(৪৩) যিনি আল্লাহকে লাভের আশায় স্বীয় জীবন উৎসর্গ করে থাকেন, তিনি সত্যিকার বীর পুরুষ।
(৪৪) যে ব্যক্তি আল্লাহকে হুক্কুল ইয়াকিন করেছেন, তিনি বেহেস্তী।
(৪৫) সাধকের জন্য তিনটি কাজ করা অপরিহার্য কর্তব্য— (ক) আল্লাহর মহব্বত (খ) আল্লাহর জিকির (গ) সমস্ত রিপু এবং কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জেহাদ করা।
(৪৬) সমস্ত শাস্ত্র পাঠ করেও সাধনা দ্বারা নফছ মোলহেমা না করলে, মানুষের পূর্ণত্ব বিকাশ লাভ হয় না।
(৪৭) যে পর্যন্ত না মানুষ তার নফছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সে পর্যন্ত সে নফছ শয়তানের ইঙ্গিতে চালিত হতে পারে।
(৪৮) দুটি বিষয় হতে সাবধান হওয়া উচিৎ— (ক) অহংকার (খ) লোভ।
(৪৯) আত্মার অবস্থা— (ক) মৃত বা জীবিত অবস্থা (খ) পরিতোষ প্রাপ্ত আত্মা (গ) জাগ্রত আত্মা। অর্থাৎ যে আত্মা আল্লাহতে নিরুদ্দেশ হয়েছে বা আল্লাহতে ডুবেছে।
(৫০) তিন শ্রেণীর লোক আছে— (ক) আল্লাহর জন্য নফছের সঙ্গে সংগ্রাম করে থাকে (খ) আল্লাহর জন্য লোকের সঙ্গে সংগ্রাম করে থাকে (গ) নিজের জন্য আল্লাহর সঙ্গে সংগ্রাম করে থাকে।
(৫১) তিন শ্রেণীর আলেম আছে— (ক) যারা বাহ্যিক জ্ঞানে জ্ঞানী; তারা বাহ্যিক জাহেরী এলম সাধারণ লোকের নিকট প্রকাশ করে থাকে (খ) আধ্যাত্মিক জ্ঞানী; উক্ত জ্ঞানের কথা আধ্যাত্মিক পন্থীদের নিকট প্রকাশ থাকেন (গ) যিনি নিজের মধ্যে ও খোদার মধ্যেও স্থিতি করে থাকেন। তাদেরকে কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনা।
(৫২) আল্লাহর প্রতি পাঁচটি বিষয় থাকা উচিৎ— (ক) ভয় (খ) আশা (গ) লজ্জা (ঘ) প্রেম ও (৩) বন্ধুত্ব।
(৫৩) সাধকের চার অবস্থা— প্রথম অবস্থা নির্জনতা, দ্বিতীয় অবস্থা জ্ঞান অন্বেষণ, তৃতীয় অবস্থা জ্ঞান অনুসারে কাজ করা, চতুর্থ অবস্থা জ্ঞান প্রচার করা।
(৫৪) সাধকের চারটি লক্ষণ— (ক) আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভর (খ) আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ প্রেম, (গ) সাধনার জন্য জাহেল লোকের জুলুম (অত্যাচার) সহ্য করা ও (ঘ) অল্প আহার ও অল্প ভোগ।
(৫৫) পাঁচটি অবস্থায় সাধক আধ্যাত্মিক আনন্দ লাভ করে থাকেন— (ক) এবাদতে (খ) আল্লাহর জিকিরে (গ) আল্লার নৈকট্য লাভে (ঘ) আল্লাহর পবিত্র প্রেম সুধা পানে (ঙ) আল্লাহর ধ্যানে।
(৫৬) পাঁচটি বিষয় হতে সাধকের সর্বদা সাবধান থাকা চাই, নইলে বেঈমান হবার ভয় থাকে— (ক) দুনিয়া (খ) শয়তান (গ) সংসার (ঘ) মানুষ শয়তান (ঙ) নফছ শয়তান।
(৫৭) হৃদয়ের মৃত্যুই প্রকৃত মৃত্যু। অর্থাৎ যার দিল মৃত।
(৫৮) হুজুরী ক্বলব ছাড়া নামাজ সিদ্ধ হয় না। ক্বলবে আল্লাহর জিকিরের প্রতি খেয়াল রেখে নামাজ পড়লেই নামাজে হুজুরী থাকে।
(৫৯) মারেফাত আল্লাহর মহব্বত ব্যতীত লাভ হয় না। যারা আল্লাহকে ভালবাসে তারাই প্রকৃত বীর পুরুষ।
(৬০) ঐশী প্রেম এমনই আগুন যা আল্লাহর প্রেম ব্যতীত সাংসারিক যাবতীয় গায়রুল্লার মায়া নাই করে দেয়।
(৬১) প্রকৃত সূফী জীবিত অবস্থাতেই যেন মৃত, তিনি আল্লাহর মধ্যে চিরজীবি হন। সূফীর আত্মা আল্লাহর প্রেমানলে দগ্ধ।
(৬২) পরকালের পাথেয় (সম্বল) সংগ্রহ করার জন্য দুনিয়ায় কাজ (আমল) কর।
(৬৩) সাধনা আল্লাহর প্রতি ঈমানকে জ্যোতির্ময় করে; তখন অন্তরে আল্লাহর ভয় হয় এবং আল্লাহর মারেফাত হাছিল হয়।
(৬৪) যে নিজেকে চিনল সে খোদাকে চিনল।
(৬৫) কম খাও, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও অর্থাৎ এবাদতের ধন সংগ্রহ কর। ইহাই মূল সম্বল।
(৬৬) যে সাধকের আত্মা নির্মল, তিনি আল্লাহর সাথে বাস করে থাকেন।
(৬৭) মানুষের উচিৎ সৃষ্ট বস্তুর মায়া ত্যাগ করে সৃষ্টিকর্তার জিকির আজকারে আত্মনিয়োগ করা, তা হলে ধীরে ধীরে সে আল্লাহ ব্যতীত যাবতীয় বিষয় বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর ওয়াহেদীয়াতে (একত্বে) বিলীন হতে পারবে। যে দেল আল্লাহর জিকির করে না, উক্ত দেলে শয়তানের বাসস্থান। যে দেল আল্লাহর জিকির করে, সেখানে শয়তান থাকতে পারে না। ফেরেশতা বাস করে।
(৬৮) যে দুনিয়া চায়; দুনিয়া তার প্রভূ ; সে দুনিয়ার দাস। যে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে, সে দুনিয়ার প্রভূ। দুনিয়া তার দাস।
(৬৯) যিনি জাহেরী এবং বাতেনী জ্ঞান (এলমে বাতেন) লাভ করেছেন, তিনিই আল্লাহ্ ও রাসূলের গুণের প্রকৃত উত্তরাধিকারী বা নায়েবে রাসূল।
(৭০) আল্লাহর জিকির এবং মহব্বতই আল্লাহ—প্রেমিক লোকের রূহের খোরাক।
(৭১) মুখে বাজে কথা বলা ও মনে গায়রুল্লাহর চিন্তা করা নিকৃষ্ট কাজ। তাই, দেল ও মুখ বাজে চিন্তা হতে বন্ধ রাখ। দেল ও মুখে আল্লাহর চিন্তা করাই সারকর্ম। দেলে মুখে আল্লাহর চিন্তা করলে দেলের মুখে আল্লাহর জিকির খুলে যায়।
(৭২) আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ ছাড়া কারও ভয় করো না; গায়রুল্লাহর উপর নির্ভরশীল হইওনা ও আশা রেখো না।
(৭৩) আল্লাহকে লাভ করতে হলে অলি আল্লাহদের সঙ্গ লাভ করা উচিৎ।
(৭৪) জীবনভর এবাদত করে শেষ নিঃশ্বাসে আল্লাহ কে ভুলে মরলে যাবতীয় উপাসনা বরবাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঈমান হারিয়ে মরবে। (৭৪) চোখের পানিতে পাপ ধৌত কর।
(৭৫) ভক্তিতে মুক্তি আছে।
(৭৬) ধর্মের উদ্দেশ্য দু’টি— (ক) হক্কুল এবাদ ও (খ) হক্কুল্লাহ অর্থাৎ বান্দার প্রতি বান্দার কর্তব্য ও আল্লাহর প্রতি বান্দার কর্তব্য পালন করাই ধর্মের উদ্দেশ্য।
(৭৭) প্রতিশোধ গ্রহণ করার চেয়ে ক্ষমা করা শ্রেষ্ঠতর।
(৭৮) পবিত্র আত্মায় আল্লাহ বিরাজ করে থাকেন। মুমিনের দেল আল্লাহর সিংহাসন। যুক্তি তর্কের সিদ্ধান্তে কেউ আল্লাহতে বিশ্বাসী হতে পারে না। অন্তরে আল্লাহকে অনুভব করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারলেই তিনি আল্লাহতে স্থির বিশ্বাসী হতে পারেন। যিনি আল্লাহতে পূর্ণ নির্ভরশীল, আল্লাহ হতে তিনি গায়েবী রুজী পেয়ে থাকেন। যে রূপ পশু—পক্ষী, কীট—পতঙ্গ আল্লাহর সাহায্যে রুজী পেয়ে থাকে।
(৭৯) আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতে পারলে দোজখ তাঁকে স্পর্শ করবে না।
(৮০) কঠিন রিয়াজত ও কঠোর সাধনায় কলিজার রক্ত পানি না করে কেহ কামালিয়তের দরজায় পৌঁছতে পারে নাই।
(৮১) বিবাহের উদ্দেশ্য বংশ রক্ষা; জীবন উপভোগ করা নহে।
(৮২) শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের পূর্ণ আমল করলেই পূর্ণ মুসলমান হওয়া যায়। শরীয়ত ও তরিকত প্রভৃতি ইসলামের অংশ। শরীয়ত, তরিকত প্রভৃতির দ্বারা আমল করে আত্মার পূর্ণত্ব বিকাশ করে ইসলামে পূর্ণভাবে প্রবেশ করা যায়। যে রূপ একটি গাছকে পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হতে হলে বীজ, বীজের শ্বাস প্রভৃতির সাহায্যেই পূর্ণত্বের বিকাশ সাধন করতে হয়। শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের উপমা সেরূপ। মারেফাত আমলের ফলতুল্য।
(৮৩) সক্ষম ব্যক্তির ছওয়াল (ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন) করা নিষিদ্ধ। পরিশ্রম করে খাওয়া ভিক্ষা বৃত্তির চেয়ে বাঞ্ছনীয়।
(৮৪) খোদা ওয়াহেদ। তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর কোন রং নেই, ছুরত নেই ও মেছাল নেই। তিনি বেনমুনা ও বেনিশান। হিংসা ও তকব্বরি খোদা তা’লা একেবারেই পছন্দ করেন না। আল কিবরিয়াও রেদাঙ্গার অর্থাৎ “বড়াই খোদার চাদর”। হাদিস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তা’লা ফরমান, অহং বা গর্ব আমার চাঁদর বা জামা। যে ব্যক্তি আমার চাদর বা জামা নিয়ে টানাটানি করবে (অহংকার বা গর্ব করবে) আমি তাকে আগুনের দরিয়ায় নিক্ষেপ করবো। আমি কারো পরোয়া করিনা।
(৮৫) তরিকত, হকিকত, মারেফাত এ তিন একত্র হলে পূর্ণ শরীয়ত হলো। অর্থাৎ এ চারটির সমন্বয়ে পূর্ণ ইসলাম। শরীয়ত মজবুত ও রক্ষা করবার জন্য তরিকত, হকিকত ও মারেফার প্রয়োজন। যে ব্যক্তি শরীয়ত ছেড়ে তরিকত, হকিকত ও মারেফাত এখতিয়ার করল ও শরীয়তকে এনকার করল সে কাফের হবে এবং যে তরিকত, হকিকত ও মারেফাত ছেড়ে দিল সে ফাছেক হবে। যে শরীয়তের হুকুমে যত মজবুত থাকবে মারেফাত তার তত সহজ হবে । আল্লাহ তা’লার গুপ্ত রহস্য তাঁর মগজে ও অন্তরে তত খুলে যাবে।
(৮৬) পাপের জন্য অনুতাপ ও ক্রন্দন না করলে গুনাহ মাফ হয়না। ভবিষ্যতে গোনাহ করবার ইচ্ছা অন্তরে থাকলে তার তওবা কবুল হবেনা। মানুষ যখন দুনিয়ার যাবতীয় মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর প্রতি ফিরে থাকে আল্লাহ্ তখন তাঁকে গ্রহণ করে থাকেন, যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করে থাকেন তাঁর প্রার্থনা কবুল করে থাকেন।
(৮৭) আল্লাহর পথের পথিকের নির্জনতাতে নিরাপদ অর্থাৎ হুয়া।
(৮৮) আল্লাহকে নির্জনে ধ্যান করাই (মোরাকাবা) আত্মার উন্নতির চিহ্ন।
(৮৯) এক ঘন্টা নির্জনে বসে আল্লাহর জিকির শত বৎসরের বে—রিয়া বন্দেগী হতে উত্তম।
(৯০) লোককে ভয় করলে আল্লাহর ভয় মন হতে দূরীভূত হয়ে যায় এবং লোকের প্রতি নির্ভরশীল হলে আল্লাহতে তাওয়াক্কুল থাকেনা (নির্ভর থাকে না)। আল্লাহকে ভয় করলে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সব প্রাণীই তাঁকে ভয় করে। যে আল্লাহকে ভয় করে না, কেহই তাঁকে ভয় করে না।
(৯১) আল্লাহর প্রিয় হতে হলে তাঁর কাজের উপর সন্তুষ্ট থাকা এবং তাঁর ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণ করা উচিৎ।
(৯২) আল্লাহর প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ তোমার সঙ্গে থাকবে। তুমিও আল্লাহর সঙ্গে থাকবে।
(৯৩) ভূল বশতঃ যে পাপ হয়, তার ক্ষমা হয়। যেমন বেহেশতে হজরত আদম (আ.)—এঁর ভূল বশতঃ খাতাহ্। কিন্তু অহংকার বশতঃ যে পাপ হয় তা ক্ষমা হয় না। যেমন শয়তানের পাপ।
(৯৪) আল্লাহ তুমি “এরূপ কর ওরূপ কর” ইত্যাদি প্রকার প্রার্থনা করলে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল হয় না; বরং আল্লাহ যা করেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকাই আল্লাহর উপর পূর্ব তাওয়াক্কুল । এবাদত আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া উচিৎ, নিজের জন্য হওয়া উচিৎ নয়।
(৯৫) সাধকের প্রাণ দুনিয়া হতে বিরাগী, পরকালের প্রতি অনুরাগী।
(৯৬) যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে থাকে তার মন নিকটবর্তী হয় এবং এস্কে এলাহী প্রবল হয়ে থাকে।
(৯৭) আল্লাহর জন্য আত্মাকে উৎসর্গ না করতে পারলে প্রকৃত এস্কে এলাহী লাভ হয় না।
(৯৮) যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রেমিক, সে আল্লাহর প্রেমিক নয়। (৯৯) কঠিন রিয়াজত ও তপস্যা ব্যতীত সাধনা লাভ হয় না।
(১০০) কার্যত করার সময় এবং কথা বলার সময় মনে করো যে, আল্লাহ্ তা দেখছেন এবং শুনছেন।
(১০১) তোমরা যা চিন্তা কর, তা আল্লাহ্ অবগত আছেন।
(১০২) যিনি বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ তাঁর সঙ্গে আছেন, তিনি পাপ করতে পারেন না।
(১০৩) সংসার মায়া ও শয়তানের দোকান। এখানে হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হবে। ফেরে পড়ে ঈমান হারানোর ভয় পদে পদে। (১০৪) যে ব্যক্তি সংসারে আত্মসুখে মত্ত হয়েছে সে অনুতাপ করবে, সংসারের মায়ায় ভুললে আল্লাহর স্মরণ থাকে না।
(১০৫) যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ করে, সর্বদা পরকালের কথা মনে করে এবং দুনিয়ার মায়া ভূলতে পারে, সে—ই জ্ঞানী এবং বীর পুরুষ।
(১০৬) বেহেশতে কাঁদা কঠিন, যেরূপ পৃথিবীতে হাসা সহজ।
(১০৭) যিনি আল্লাহকে চিনেছেন, তিনিই তাঁকে মহব্বত করেছেন। যে সংসারকে ভালবেসেছে, সে আল্লাহর মহব্বত হারিয়েছে।
(১০৮) যে পর্যন্ত হৃদয় কথা না বলে সে পর্যন্ত জ্ঞানীগণ নীরব থাকেন।
(১০৯) সাধক নিজের কথা বলেন না, আল্লাহর এলহামে কথা বলে থাকেন। তাতে লোকে সন্তুষ্টই হউক বা দুঃখিত হউক। তাঁরা সেদিকে লক্ষ্য করেন না। (১১০) আত্মা যখন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, তখন আত্মা পরিতোষ প্রাপ্ত হয়ে থাকে।
(১১১) যিনি আল্লাহকে পেলেন, তিনি সবই পেলেন। * হতভাগ্য সে ব্যক্তি যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেম সুধারূপ অমৃত পান না করে দুনিয়া হতে প্রস্থান করে।
(১১২) যে ব্যক্তি বেহেস্তের জন্য আল্লাহর এবাদত করে সে আওরত। এবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা উচিৎ।
(১১৩) সূফীগণ নফছের সঙ্গে যুদ্ধ (জিহাদে আকবর) করে থাকেন।
(১১৪) যার হৃদয়ে নূর (জ্যোতি) নেই, সে অন্ধকারে বাস করে। তাঁর কবরও অন্ধকার হবে।
(১১৫) আল্লাহর প্রেমিক সূর্য্য তুল্য। তা হতে জ্যোতি বিকীর্ণ হয়ে থাকে। তিনি প্রদীপ তুল্য হতে জগৎ আলোকিত হয়ে থাকে।
(১১৬) তত্ত্বদর্শী, তত্ত্বজ্ঞানের আলোকে আলোকিত হন। তিনি তাতে আশ্চর্য ব্যাপার দর্শন করে থাকেন।
(১১৭) সাধক লোক জগতে মৃত লোকের মত জীবন যাপন করে থাকেন। তাই রিপু তাদের ক্ষতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি স্বীয় জীবনকে সাধনার জন্য প্রস্তুত করেছেন আল্লাহ তাঁকে সেদিকে পথ দেখান।
(১১৮) আল্লাহর উপর আত্মনির্ভরের প্রথম সোপান এই যে, শব (মৃত লাশ) ধৌতকারীর হতে শবের যে অবস্থা, নির্ভরশীলের অবস্থা অদ্রুপ।
(১১৯) পৃথিবীর লোকে নানা ভাবে নানা জিনিসে পূজা করে থাকে। কেউ বা পুতুল পূজক, কেউ বা ধন সম্পত্তির পূজক, কেউ বা স্ত্রী—পুত্রের উপাসক, আবার কেউবা বাণিজ্যের উপাসনা করে থাকে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর উপাসক খুব কম।
(১২০) সূফিদের ক্বলব বা আত্মা আল্লাহর জিকিরে জিন্দা থাকে। আর নফস বা কুপ্রত্তি মৃত থাকে।
নিবেদক:- সূফিবাদী লেখক ও গবেষক- কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী