প্রথম যখন চিন্তার জগতে বসবাস করতে লাগলাম।
প্রথম যখন চিন্তার জগতে বসবাস করতে লাগলাম ঠিক তখন থেকে নিজের এবং আশেপাশের জগতে ভিন্ন রকমের উপলব্ধির জন্ম হলো। জাগতিক জীবনে প্রিয় মানুষের সুখ বা হাসি আমাকে সুখী করে, হাসায়; তবে এর বিপরীতে অপ্রিয় কারো সুখ আমাকে দুঃখী করলেও এর বিপরীত রকম অনুভূতিও আছে।
আপনি, আমি, আমরা সবাই এই জাগতিক জীবনে একটি চিরন্তন এককের দিকে নিরন্তর ছুটে চলছি। কখনো ভাবছি আমি সুখে আছি; হাসছি, খেলছি। আবার পরক্ষণেই কষ্টে কাঁদি বা মন খারাপ করি, তখন আকাশের কালো মেঘের ছায়া পড়ে আমার শরীরের পরতে পরতে, আমাদের উপর ভর করে চাঁদহীন রাতের অমোঘ অন্ধকার। কিন্তু আপনি যদি গল্প বানাতে জানেন মনে মনে, তখন আপনি হাঁটবেন আর আনন্দের সাথে নিজের আশু সুখের গল্প বানাবেন। সত্যি হোক কিংবা মিথ্যা, সম্ভব কিংবা অসম্ভব, প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় সব ধরনের গল্প।
আপনার চারিপাশে কী ঘটছে আপনি দেখছেন না, আপনার চারপাশের লোকজন, গাড়ি, গাছপালা, পিচঢালা রাস্তা এমনকি রাস্তার সেই ককুরটা কিংবা আমাদের ভাষায় বিশ্রি শব্দে রব তোলা সেই কাকটাও জানবে না আপনি কোথায় আছেন, কী করছেন, কী ভাবছেন! অন্তহীন পথের দিকে আপনি চলছেন, ভাবছেন, গল্প বানাচ্ছেন। জাগতিক জীবন চালনায় আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে আপনি হয়তো ভাবছেন, এর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবন আপনার জাগতিক জীবনকে সহজ ও স্বচ্ছন্দ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রজীবনে একজন শিক্ষার্থী যে মোটিভেশান সবচেয়ে বেশি পায় তা হলো-জীবনে সফল হতে হবে।
সফলতার জন্য তাকে এই বিষয়ে জানতে হবে, ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, অমুককে অনুসরণ করতে হবে- তমুকের মতো চলতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমার মতে, সার্থকতা, সফলতা ও মূল্যবান হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি বিষয়। যদি তিনটি বিষয়কে একটু ব্যাখ্যা করা যায় তবে এ সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো স্পষ্ট হবে আশা করছি। ধরুন, আপনি কোনো একটি কাজে দীর্ঘসময় লেগে আছেন এবং শেষ পর্যন্ত আপনি কাজটি শেষ করতে সমর্থ হয়েছেন, এতে আপনার শত পরিশ্রমের ইতি ঘটেছে, আপনি খুবই খুশি।
এ পর্যায়ে আপনার স্বগোতক্তি কী হয়? আপনি হয়তো বলেন- ‘আজকে আমি সফল বা সার্থক’। একটু গভীরভাবে বিষয়টিকে অনুধাবনের চষ্টা করলে দেখবেন কাজটি আপনার জন্য যত গুরুত্বপূর্ণ অথবা বড় হোক না কেন এখানে আপনি ‘সফলতা’ বা ‘সার্থকতা’ এই শব্দদ্বয়কে অতি ক্ষুদ্রার্থে ব্যবহার করেছেন, মনের অজান্তেই। আপনি পরীক্ষা দিলেন, ভালো ফলাফল অর্জন করলেন, আপনি এবং আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী এমনকি শত্রুরাও বলবে আপনি সফল হয়েছেন। আপনি আপনার দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটিয়ে আপনার বহু প্রত্যাশিত, সমাজের কাছে আকাঙ্ক্ষিত এবং সর্বজন পছন্দের চাকরিতে যোগদান করলেন। কিন্তু দেখুন, আপনাকে আবার সেই সবাই ‘সফল’ বলছে। আর আপনি নিজেও ভাবছেন আপনি সেই তথাকথিত ‘সফল’ একজন মানুষ।
কিন্তু এই পর্যায়ে আমাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, এখানে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী আর সমাজের লোকেরা আপনাকে যেমন মূল্যবান ভাবছেন না ঠিক একইসাথে আপনি নিজেও নিজেকে সফল আবছেন কিন্তু মূল্যবান ভাবছেন না। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে আপনি যে সকল শিক্ষণীয় বাণিসমগ্র দেখতে পান তার অধিকাংশের ভাবার্থ থাকে জীবনে মূল্যবান হওয়ার। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ অংশই ঐ সকল বাণিগুলোকে সফলতার চাবিকাঠি বলে ধরে নিই। মজার বিষয় হচ্ছে মূল্যবান মানুষগুলো জাগতিক জীবনে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়ে বেশি।
আজকে আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের পথচলায়, জীবনযাত্রার পরতে পরতে, মফস্বলে-নগর-বন্দরে সফল মানুষদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনি যেখানেই যাবেন আপনাকে গল্প শোনানো হবে সফল মানুষদের, পরামর্শ দেয়া হবে তাদের মতো হওয়ার, তাগিদ দেয়া হবে তাদের পথ-পদ্ধতি অনুসরণ করার। হয়তো আমরা সবাইও তাই করছি। অপরদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা! পৃথিবীতে এতো এতো সফল মানুষ থাকতে পৃথিবী ক্ষণে ক্ষণে উত্তপ্ত হয় কেন? সফল মানুষ বা জাতিগুলো উন্মুক্ত মঞ্চে দুর্বলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকি দেয় কেন? পীড়িতের আর্তনাদে আকাশ-পাতাল প্রকম্পিত হয় কেন? তথাকথিত আত্মরক্ষার নামে শক্তিশালী পক্ষ অস্ত্র-গোলাবারুদ-বোমার মতো মানবতা বিধ্বংসী সরঞ্জাম বানায় কেন?
আমার জানা মতে, মূল্যবান মানুষের শত্রুর তুলনায় তাদের চিন্তা ও দর্শনের শত্রুর সংখ্যা বেশি। তারা সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় হলেও তাদের দর্শন সমাজ বা রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য হয় না। যদিও এই সকল মূল্যবান মানুষদের পদধূলিতে হাজারবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে আমাদের এই বসুন্ধরা, মুখরিত হয়েছে তার ভূমি-বায়ু-পানি, মহাসত্যের ঠিকানা খোঁজে পেয়েছে লাখো-কোটি আদমসন্তান।
আধ্যাত্মিকতার অমোঘ পেয়ালার পবিত্র জল পান করে তারা পৌঁছে গিয়েছে অসীমের সীমানায়। অন্যদিকে, সফল মানুষগুলো তাদেরকে বারবার প্রলুব্ধ করেছে, তাদেরকে লোভী, কপট, প্রতারক বানিয়ে তাদের জীবনে সফলতার নরক-যন্ত্রণার সুখ এনে দিয়েছে। তাদেরকে মানুষ হিসেবে সফল করতে গিয়ে মনুষ্যত্বের বলিদান করা শিখিয়েছে।
লেখা:-
এম. আসিফুল ইসলাম নূরী (সহকারী শিক্ষক)
রামু ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ,