হোমপেজ ইলমে মারেফত মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ৩য় পর্ব

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ৩য় পর্ব

2559

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ৩য় পর্ব (শেষ)

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় এবং খোদাপ্রাপ্তি সাধনায় ইহাদের ভূমিকাঃ- (৩ পর্বের – ৩য় এবং শেষ পর্ব) খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞনের আলোকে শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত।

হযরত শেখ সাদী (রঃ) ছাহেব একটি রূপক কাহিনীর মাধ্যমে মানব রূহের উক্ত অবস্থার এবং খোদাপ্রাপ্তির নিদর্শন মানব দেহের দশ লতিফার চমকপ্রদ এক ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন।

কাহিনীটি হইল:-

একজন জ্ঞানী ভদ্রলোক, বাড়ী তাহার আফগানস্থানে। তিনি স্ত্রী – পুত্র পরিজনসহ সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাহার অতি আদরের পুত্রধন একদিন হারাইয়া গেল, বহু তালাস করা হইল কিন্তু ছেলেকে পাওয়া গেল না। তিনি নিরাশ না হইয়া পুত্রের অনুসন্ধান কার্য চালাইয়া গেলেন। একদিন পুত্রের খোঁজে বাহির হইয়া নির্জন এক এলাকা অতিক্রম করিবার সময় দেখিলেন অতি আশ্চর্য এক দৃশ্য। এক বৃদ্ধা, দেখিতে কুৎসিত কদাকার। তাহার সম্মুখপ্রান্তে বসিয়া আছে তাহারই আদরের পুত্রধন।

সামনাসামনি বসিয়া অপলক নেত্রে সেই বৃদ্ধার পানে তাকাইয়া রহিয়াছে। পুত্র সে বৃদ্ধার ধ্যান করিতেছে । পিতা পুত্রের নিকট নিজের পরিচয় দান করিয়া বলিল, “হে পুত্র! তোমার শোকে তোমার গর্ভধারিনী মা শয্যাশায়িনী। তোমার আত্মীয় – স্বজন পাগল প্রায়। তুমি দ্রুত চল আমার সাথে।”

কিন্তু পুত্র বলিল, “তুমি কে হে ভদ্রলোক, আমি তোমাকে চিনি না। আমার মা কে? আমি জানি না! আমার বাড়ী ঘড়, বন্ধু – বান্ধব, আত্মীয় – স্বজন কিছুই নাই। সব কিছুই আমার এই বৃদ্ধা। আমি বৃদ্ধার প্রেমে বিভোর। বৃদ্ধাই আমার জীবন, বৃদ্ধাই আমার মরণ। এক মুহূর্ত বৃদ্ধার অদর্শনে আমি মারা যাইব। কাজেই তুমি যাও। আমাকে বিরক্ত ও বাধা দান করিও না। বৃদ্ধার প্রেমসূধা পানে আমাকে বাধা দান করিও না। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিও না।”

পুত্রের এই প্রকার কথা শ্রবণে পিতা আশ্চর্যান্বিত হইলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন। পিতা তাহার জ্ঞান সাগরে ডুব দিলেন। তাফাক্কুর বা চিন্তা করিতে লাগিলেন পুত্রের এই হীন আবস্থা দেখিয়া। তিনি ভাবিলেন, নিশ্চয় পুত্রকে ঐ বৃদ্ধা যাদু করিয়াছে। যাদুর প্রভাবে পুত্র তাহার পিতা – মাতা, আত্মীয় – স্বজন, বাড়ী – ঘরের কথা ভুলিয়া গিয়াছে। কাজেই পুত্রকে যাদুর প্রভাবমুক্ত করিতে হইবে। কিন্তু কিভাবে ঐ চরিত্রভ্রষ্টা বৃদ্ধা তাহার পুত্রকে যাদু করিল?

তিনি যাদুর উপকরণাদির সন্ধান করিতে লাগিলেন। হঠাৎ তিনি দেখিতে পাইলেন, বৃদ্ধার পার্শ্বে দুইটি পাথর। একটির উপরে আর একটি বসানো। পিতা ভাবিলেন– নিশ্চয়ই ইহার ভিতর কোন রহস্য লুকায়িত। তিনি উপরের পাথরটিকে সরাইলেন। পাথরটি অপসারণের পর তিনি একটি লম্বা চুল দেখিতে পাইলেন, যে চুলে দশটি গিরা লক্ষ্য করিলেন। জ্ঞানী পিতা প্রথম গিরাটি খুলিলেন। ইহাতে পুত্রের চৈতন্য ফিরিয়া আসিল। সে তাহার বাবাকে চিনিয়া জড়াইয়া ধরিল। ইহা দর্শনে জ্ঞানী পিতা আসল রহস্য বুঝিতে পারিলেন। তিনি দ্বিতীয় গিরাটি মুক্ত করিলেন। ছেলের হা– হুতাশ আরও বাড়িয়া গেল। তাহার মায়ের কথা স্মৃতিপটে ভাসিয়া উঠিল। সে অঝোর নয়নে ক্রন্দন শুরু করিল। জ্ঞানী পিতা তৎপর ৩য়, ৪র্থ, ৫ম গিরাটি মুক্ত করিলেন। পুত্র তাহার উৎসে, তাহার আবাসস্থলে ফিরিয়া যাওয়ার জন্য পিতাকে উত্যক্ত করিতে লাগিল।

উপরোক্ত পাচটি গিরাকে হযরত সাদী (রঃ) আলমে আমরের পাঁচটি লতিফাকে বুঝাইয়াছেন। এবং জ্ঞনী পিতাকে পীরে কামেলের রূপক হিসেবে উল্লেখ করিয়াছেন। তৎপর অবশিষ্ট পাঁচটি গিরা যাহা আলমে খালকের পাঁচ লতিফা যথা – আব, আতস, খাক, বাদ ও নাফসের সহিত তুলনা করিয়াছেন। এইভাবে আলমে আমরের পাঁচ লতিফার গিরা যখন খুলিয়া দেওয়া হইল, ছেলে তাহার বাবাকে চিনিতে পাড়িল, তাহার মাকে স্বরণ করিল, আবাসস্থলের কথা তাহার স্বরণে পড়িল। তৎপর ছেলে বাবাকে জড়াইয়া ধরিল দেশে লইয়া যাওয়ার জন্য। বাবাকে সে বলিল, “বাবা, আমি এখানে কেন? আমাকে বাড়ী লইয়া চলেন।“

ছেলে বাড়ী যাওয়ার জন্য অস্থির হইল। আধ্যাত্মিকতত্ত্বে জ্ঞানী বাবা ছেলেকে বলিলেন , “ছবুর কর, ধৈর্য ধারণ কর। এখনও পাঁচটি গিরা অবশিষ্ট আছে। সে গিরাগুলি খুব শক্ত। অস্ত্র ব্যতীত সেই গিরাগুলি কর্তন করা যাইবে না। শান পাথর দ্বারা অস্ত্রকে ধারালো করা হয়। তেমনি শান পাথর হইল নফি–এসবাদ জেকের।“ এই শানপাথররূপী নফি– এসবাদ জেকেরের দ্বারা জ্ঞানী বাবা একটি একটি করিয়া অবশিষ্ট গিরাগুলি কাটিতে লাগিলেন। সেই বৃদ্ধা কুহকিনীর হাত হইতে ছেলে মুক্ত হইল।

তাই শেখ সাদী (রঃ) ছাহেব ফরমাইয়াছেন, “তোমার এমন স্ত্রীলোকের সংগে প্রেম করিও না যে প্রতিদিন সকালে একটি করিয়া স্বামী গ্রহণ করে। এই কুহকিনী দুনিয়া–বৃদ্ধা এক রমণী। দেখিতে অতিব কুৎসিত। তাহার দুই পাটি দাঁত আছে। সম্মুখে দাঁত দ্বারা সে হাসিতে থাকে কিন্তু পিছনের দাঁত দ্বারা সে কাটিয়া হালাক করে।“

তুমি যদি এই কুহকিনীর হাত হইতে বাচিতে চাও, তবে পীরে কামেলের কদমকে শক্ত করিয়া ধর। পীরে কামেলই একমাত্র তাহার তাওয়াজ্জুয়ে এত্তেহাদীর দ্বারা এই কলংকিনী, কুহকিনী রমণীর হাত হইতে বাঁচাইতে পারেন। তাই জ্ঞানী পিতা মোর্শেদে কামেলের সংগ ধর এবং কলংকিনীর কুহক হইতে বাঁচিতে চেষ্টা কর। তবেই তুমি দুনিয়ার কুহক হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য অর্জন করিতে পারিবে। একমাত্র পীরে কামেলের তাওয়াজ্জুহ দ্বারাই ইহা সম্ভব। তাই বলা হয়, “যাহার পীর না তাহার পীর শয়তান“।

নাফস হইল তোমাদের শরীরে শয়তানের পক্ষ হইতে সিপাহসালার। এই নাফসই তোমাদের মধ্যে সমস্ত কু-কথা, টানিয়া আনে। সকল কুকর্ম, কু-চিন্তা এবং ওয়াসওয়াসা দেওয়াই হইল এই নাফসের স্বভাব।

তাই পারস্যের মহাসূফীসাধক হযরত মাওলানা জালাল ঊদ্দিন রূমী (রঃ) ছাহেব এই নাফসকে কাল সাপের সহিত তুলনা করিয়াছেন। তিনি বলেন ,

“হিসনা কোশাদ মারে রাজ্যে জাল্লেপীর
দামনে আ নাফসরে কোশরা সাফতগীর।“

অর্থাৎ – তোমরা যদি নাফসরূপী কাল সাপের ছোবল হইতে বাঁচিতে চাও, তবে নাফসহ্নতা মোরশেদে কামেলকে শক্ত করিয়া ধর।

সমস্ত বুজুরগানে দ্বীন একই মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, “তোমরা নফসের সহিত জেহাদ কর।“

তোমরা যখন নামাজে দাঁড়াও , তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া নামাজে দণ্ডায়মান হও। তোমরা বল, “ইন্নি ওয়াজজাহতু ওয়াজুহিয়া লিল্লাজি ফাতারাছ ছামাওয়াতে ওয়াল আরদা হানিফাউ ওয়ামা আনা মিনাল মশরেকীন। “ (সূরা আনআম, আয়াত নং-৭৯)

অর্থাৎ “আমি মুখ ফিরালাম সেই আল্লাহর দিকে যিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং আমি কখনও মোশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নহি।“

উপরের এই প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া, হলফ করিয়া তোমরা যখন নামাজে দাঁড়াও তখন তোমাদের মনে কি কোন কু-চিন্তা, বাজে কথার উদয় হয় না? তোমরা কি দেখ না? যে কত পুরাতন বন্ধুর স্মৃতি, কত মামলা – মকদ্দমার কথা তোমাদের মনে আসিয়া মনকে ভিন্ন দিকে ঘুরাইয়া লয়। যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া নামাজে দন্ডায়মান হইলে, তাঁহার কথাই তোমাদের আর স্বরণ থাকে না। কিন্তু আল্লাহপাক ফরমান- “আমিআলেমুন বেজাতিস সুদুর।”

অর্থাৎ – “আমি তোমাদের দেলের খবর রাখি।” (সূরা- হুদ, আয়াত নং- ৫)

তাই, হে জাকেরানগণ! তোমরা যদি খাঁটিভাবে নামাজ আদায় করিতে চাও, বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর বন্দেগী করিতে চাও, তবে নাফসের কু-খায়েশ, কু-চিন্তা হইতে বাঁচিবার আপ্রাণ চেষ্টা। আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন চিন্তা যেন মনে আসিতে না পারে। নাফস শয়তান তোমাদের শরীরের শিরা-ধমনী, মাথার চান্দি হইতে পায়ের তলা পর্যন্ত, প্রতি গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে তোমাদেরকে ঘেরাও করিয়া রাখিয়াছে, যেন তোমরা আল্লাহর দিকে না যাইতে পার। আল্লাহর কথা তোমাদের মনে না আসিতে পারে। তোমরা যদি নাফসের এই করাল গ্রাস হইতে বাঁচিতে চাও, তবে পীরে কামেলকে শক্ত করিয়া ধর। পীরে কামেলের ওছিলা ব্যতীত দ্বিতীয় আর উপায় নাই। বর্তমান জামানার মোজাদ্দেদ হযরত খাজাবাবা শাহসূফী এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব। তাহাঁর কদম শক্ত করিয়া ধর এবং রাবেতায়ে কালব–ফিশ–শেখ হাছিল কর, তবেই কল্যাণ। আল্লাহ তোমাদের শক্তি দান করুন, যাহাতে নাফসের করাল গ্রাস হইতে তোমরা বাঁচিতে পার।

“হে আল্লাহ! আপনার মহব্বত দেলে পয়দা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আপনাকে রাজি রাখাই আমাদের কর্তব্য ও কর্ম। আপনি দয়া করিয়া আপনার মারেফাত ও মহব্বত ভিক্ষা দিন। হে খোদা! আপনি পরম দয়ালু, দাতা ও সর্ব শক্তিমান। আপনার দয়া ব্যতীত নাফসের করাল গ্রাস হইতে বাঁচিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। তাই নাফসের সাথে এই জেহাদে আপনার অনুগ্রহে আমরা যাহাতে বিজয়ী হইতে পারি, সেই করুণাই আপনার কাছে আমরা ভিক্ষা চাই। আপনি দয়া করিয়া নাফসের করাল গ্রাস হইতে বাঁচান।”

তাই মোর্শেদে কামেলের মহব্বতের রজ্জু ধরিয়া তোমরা চলিতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দয়া করিবেন। আল্লাহ তোমাদের সহায় থাকিবেন। নিশ্চয় তিনি তোমাদের কামিয়াবী বখশিস করিবেন। তোমরা পীরের হুকুম ঠিক ঠিক মত প্রতিপালন কর। দমে দমে আল্লাহকে স্বরণ কর–তবেই কল্যাণ। মোর্শেদে কামেলের তাওয়াজ্জুহ দ্বারাই এই অপূর্ব নেয়ামত হাছিল করা যায়। ইহা ব্যতীত বিকল্প কোন পথ নাই। তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের রজ্জু ধরিয়া সত্য পথে চলিতে থাক। আল্লাহ তোমাদের কবুল করুন। আমীন!

গ্রন্থসূত্র- শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের “নসিহত- সকল খন্ড একত্রে, নসিহত নং- ২০, পৃষ্ঠা নং-২১৩, ২১৪ ও ২১৫।”

» মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয়- সবগুলো পর্ব।